Don't wanna be here? Send us removal request.
Text
আলিনগরের আরশিকথা
এই কাহিনী দুটি বাঙালি চরিত্রের কাল্পনিক আলোচনামাত্র। আর সেই আড্ডার প্রেক্ষাপটে রয়েছে 'দুটি আপাত বাঙালি শহর' এবং 'দুটি কেল্লা'। চরিত্রদুটির এই আলোচনায় আপনি হয়ত খুঁজে পেতে পারেন নিজেকে... অথবা ইতিহাসের সেই আলিনগরকে যাকে হয়ত 'খুঁজে' দেখা হয়নি।

'আলিনগরের কেল্লা দেখেননি নিশ্চয়ই?'
'না মশাই...। আলিনগর তো যাইনি কোনও দিন ! আলিনগর কোন স্টেটে...... মধ্যপ্রদেশ কি?'
'আচ্ছা বা�� দিন......। কলকাতার কেল্লা দেখেছেন ?'
'কেল্লা? কলকাতায়? ওহ... ফোর্ট উইলিয়ামের কথা বলছেন কি?'
'আজ্ঞে। ফোর্ট উইলিয়ামের কথাই বলছি। আচ্ছা বলুন তো... ফোর্ট উইলিয়ামের প্রতিষ্ঠাতা কে?'
কেন...... লর্ড ক্লাইভ।
'ফোর্ট উইলিয়াম' কোথায় জানেন?
'ইয়ার্কি করছেন? কেন...... ওই তো ময়দানের পাশে।'
'নাহ......। বিস্তর গণ্ডগোল। আচ্ছা সহজ প্রশ্নে আসি --- কলিকাতার গোড়াপত্তন কে করেন?'
কেন...... জোব চার্নক। সত্যজিৎ বাবু বলে গেছেন যে সাহেবের নাম জোব চার্নক...... জব চার্নক নয়। ফেলুদা পড়েননি?'
'আচ্ছা... সালটা মনে আছে?'
'কেন থাকবে না? ১৬৯০। ইতিহাসে আমার লেটার ছিল বুঝলেন। সেই প্রথম বাংলার মাটিতে ইংরেজদের পদার্পণ। তারপর দুশো বছর......।'
'অ্যাঁ... তার মানে আপনি বলতে চাইছেন যে চার্নক সাহেবের আগে ইংরেজরা বাংলায় আসেনি।'
'এটা আবার কোনও প্রশ্ন হল! আপনি তো মশাই জ্বালিয়ে মারলেন। চার্নক সাহেব ১৬৯০ সালের ২৪শে আগস্ট গোবিন্দপুর, সুতানুটি আর কলিকাতা... এই তিনটি গ্রাম নিয়ে কলিকাতার গোড়াপত্তন করেন......। শুনুন...... ১৯৯০ সালে আমার মাধ্যমিক। ওই বছর 'কলিকাতার ৩০০ বছর' রচনাটি দারুণ তৈরি করেছিলাম।'
'দাঁড়ান মশাই...। কোথাও একটা ভুল......'
'কোনও ভুল নেই......। আচ্ছা আপনি সাবর্ণ রায়চৌধুরিদের নাম শোনেন নি? ওই যে যাদের বাড়ির দুর্গাপুজো হেব্বি ফেমাস। বেহালা বড়িশার দিকে বাড়ি......মানে আমাগো দাদার বাড়ির কাছে...... বুঝলেন। গেলবার পুজোয় আমার অফিসের কয়েকজন ঘুরে এসেছে 'পুজো পরিক্রমার' বাসে চেপে। এইবার পুজোতে ভাবছি আমিও একবার......। তাদের কাছ থেকেই তো ওই তিনটি গ্রাম কিনে......'
'আমায় মাপ করবেন। কিন্তু আপনার তথ্যে কতকগুলো দস্তুরমত ভুল আছে ----
১। কলকাতার কেল্লা মানে ফোর্ট উইলিয়ামের প্রতিষ্ঠাতা স্যার জন গোল্ডসবোরো আর সেই ফোর্ট উইলিয়াম ময়দানে নয়... ডালহৌসিতে তে ছিল... মানে এখন যেখানে জি পি ও।
২। চার্নকবাবু গত হন ১৬৯৩ তে আর তার পাঁচ বছর বাদে মানে ১৬৯৮ এ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বেহালার সাবর্ণ রায়চৌধুরিদের কাছ থেকে গোবিন্দপুর, সুতানুটি আর কালিকাতা, এই তিনটি গ্রামের দখলদারি (lease) নেন বার্ষিক ১৩০০ টাকার বিনিময়ে।
৩। আর জোব চার্নক কলকাতার গোড়াপত্তনকারী নন বা ২৪শে আগস্ট কলকাতার জন্মদিন নয়। একথা আমি নয়...... কলকাতা হাইকোর্ট বলছে। রায় বেরিয়েছিল ২০০৩ সালে।
'অ্যাঁ...... বলেন কি মশাই। কিন্তু......'
'হ্যাঁ... এই কিন্তুটাই হল গিয়ে আসল কথা। এই রকম অনেক কিন্তু-ই আছে যা আমাদের জ্ঞ্যান পরিধির অন্তরালেই থেকে যায়। ��িছু জানা যায়...... কিছু জানা যায় না। আচ্ছা ভেবে দেখেছেন কোনদিন কি যে...... চার্নকবাবু জাহাজে করে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ করে 'এই যে কলকাতা' বলে কিছু পেয়েছিলেন? নাকি অন্যকিছু? আর যদি পেয়েও থাকেন তাহলে সেই জলা-জঙ্গলে ভরা ম্যালেরিয়া প্রবণ জায়গায় কি মরতে ঘাঁটি গেঁড়ে বসলেন?'
'এটা ভাবব?'
'অবশ্যই ভাববেন। আচ্ছা...... বলুন তো জোব চার্নক কে ছিলেন? মানে ভাস্কো-ডা-গামার মতো কেউ কি...... যিনি ঘুরে ঘুরে দেশ আবিষ্কার করতেন?'
'জানি না মশাই। আপনিই বলুন। আমার যেন কেমন সব ঘেঁটে গেল...।'
'ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল ব্রিটিশ গভরমেন্ট এর এক প্রাইভেট কোম্পানি...... যার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সাথে ব্যাবসা করার জন্যে। সেই কারণে তাদের ভারতে পাড়ি। প্রধান উদ্দেশ্য -- রেশম আর মশলার ব্যবসা। সালটা তখন ১৬০৮। ওই একই উদ্দেশ্যে ফরাসী (French) ও ওলন্দাজ (Dutch) কোম্পানির দলও তখন পূর্ব ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বাংলা, উড়িষ্যা ও বিহারে নতুন কারখানা খোলার জন্যে দিল্লির মসনদে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের কাছে ফরমায়েশ করে বসে আছে। স্বভাবতই বাংলা তখন মুঘল দের প্রেরিত গভর্নরদের শাসনে। জোব চার্নক ছিলেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন বিশ্বস্ত কর্মচারী, যাকে এজেন্ট হিসেবে কোম্পানি হুগলী কাশিমবাজারে পাঠিয়েছিল, মূলত পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে (একত্রে বাংলা) ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করার জন্যে। মাসিক বেতন ওই দেড়-দু পাউন্ড।'
'এজেন্ট?...... ও বাবা! আমি তো জোব সাহেব কে কলকাতার 'ফাদার ফিগার' টাইপ ভাবতাম। আর আপনি তাকে এজেন্ট বলছেন? মানে আমাদের অফিস যে রকম আমাদের অফিসিয়াল টুরে পাঠায় সেরকম?'
'কতকটা সেরকমই। তবে তার জন্যে তার বেতন বা ডি এ কি রকম বেড়েছিল, ইতিহাসে তার কোনও উল্লেখ নেই।'
'অগত্যা...।'
'যাই হোক...... ফিরি ১৬৪২ এ......। শুনলে খুশি হবেন হয়ত...... যে আর পাঁচটা কোম্পানির মতো প্রথম দিকে (মানে ১৬৬০ অবধি) কোম্পানির ব্যাবসা রীতিমতো ধুঁকছিল। অবশেষে ১৬৬০ এর পর মানে দিল্লির মসনদে অউরঙ্গজেবের অভিষেকের পর আর চার্নক সাহেবের তৎপরতায় কোম্পানির ব্যাবসা ফুলে ফেঁপে ওঠে।'
'তারপরেই তো ১৬৯০...... মানে হুগলী থেকে কলকাতা? তাই তো?'
'না স্যার...। ব্যাপারটা অত সহজে হয়নি।'
'থ্রিলিং কিছু?'
'তবে যা ঘটেছিল...... তা আমার আপনার খুব চেনা। বুঝতেই পারছেন......বিদেশি কোম্পানি...হেব্বি ব্যাবসা শুরু করছে......সরকারী আমলারা (পড়ুন মুঘল অফিসিয়ালস) পিছিয়ে থাকে কেন। নতুন নতুন সরকারী ট্যাক্সের বোঝা (জিজিয়া কর), শায়েস্তা খানেদের মতো প্রভাবশালী গভর্নরদের বিভিন্ন প্রকার দাবি দাওয়া, ঘুষ আদায় এবং উপরন্তু তখন ফরাসী এবং ওলন্দাজদের কোম্পানির সাথে ব্যাবসায়িক প্রতিযোগিতা ---সব মিলিয়ে পরবর্তী কয়েক বছরে কোম্পানির ব্যাবসা প্রায় লাটে ওঠার জোগাড়। শেষ মরণকামড় দিতে কোম্পানি মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সালটা তখন ১৬৮৬। ইংল্যান্ড থেকে জাহাজ পথে সৈন্য পাঠানো হয় আর আপনার জোব চার্নক ছিলেন ব্রিটিশ বাহিনীর কম্যান্ডার। ইতিহাসে এই যুদ্ধকে চাইল্ড ওয়ার বলা হয়।'
'শায়েস্তা খান.?..... কস্মিনকালে এরকম নাম শুনেছি বলে তো মনে করতে পারছি না।'
'অউরঙ্গজেবের বিশ্বস্ত অনুচর। শিবাজি থেকে গোলকোন্ডা...... ভারতবর্ষের ইতিহাসের বহু যুদ্ধের কাণ্ডারি এই শায়েস্তা খান।'
'ছাড়ুন মশাই শায়েস্তা খানকে। ......... নাম শুনেই পিলে চমকে যায়। তবে আপনার ব্যপারটা আন্দাজ করতে পারছি...। মানে আপনার ওই 'শিশু যুদ্ধে' শায়েস্তা খানকে শায়েস্তা করেই........ চার্নক সাহেব...... কলকাতা...'
'আজ্ঞে না... হয়েছিল ঠিক উল্টোটাই। শায়েস্তা খানের তাড়ায় চার্নক ও তার দলবল হুগলী থেকে আশ্রয় নেন সুতানুটিতে। তারপর সেখান থেকে তাড়া খেয়ে দলবল সমেত মেদিনীপুরের হিজলি দ্বীপে। তিন মাসের মধ্যে চার্নক সাহেবের বেশীর ভাগ সৈন্য ওই খানে পানীয় জলের সঙ্কটে ও ম্যালেরিয়ায় মারা যায়। অবশ্য শেষমেশ মুঘলদের সঙ্গে বিভিন্ন ব্যাবসায়িক চুক্তি শেষে কোম্পানি বাংলায় নিজেদের ব্যাবসার পাঠ প্রায় তুলে দেয়...আর চার্নক সাহেবকে মাড্রাস পাঠিয়ে দেওয়া হয় ১৬৮৯ সালে।'
'মানে চার্নক সাহেব মাড্রাসেও গেছিলেন। আমি তো ভাবতুম যে উনি কলকাতার বাইরে কোনও দিন...।'
'হ্যাঁ স্যার গেছিলেন.... মাড্রাসও যে তখন কোম্পানির আর এক ঘাঁটি। তবে এক বছরের মধ্যে ফিরেও আসেন। ১৬৯০ এ বিশেষত অউরঙ্গজেবের তৎপরতায় কোনও এক রাজনৈতিক কারণে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর হয় কোম্পানি ও মুঘলদের মধ্যে। কোম্পানিকে নিজেদের মতো ব্যাবসা করার অনুমতিও দেওয়া হয় বাংলায় বার্ষিক ৩০০০ টাকা ট্যাক্সের বিনিময়ে। জোব চার্নক ২৪শে আগস্ট ১৬৯০, মাড্রাস থেকে ফিরে আসেন বাংলায়, নামেন সুতানুটিতে, শুরু করেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বিতীয় ইনিংস ইন বেঙ্গল। এখনও কিন্তু কলকাতা আসেনি.........।'
'হুম'।
'অবিশ্যি ১৬৯৩ এ জোব চার্নক মারা যান আর কলকাতা বা বলা ভালো কালিকাতা ফ্রেমে আসে আরও পাঁচ বছর বাদে, মানে ১৬৯৮। ওই সেই জমিদার সাবর্ণ রায়চৌধুরিদের থেকে কোম্পানির তি��টি গ্রামের lease এবং এই তিনটি গ্রামকেই কেন্দ্র করে ব্যবসা বৃদ্ধি। মুঘলদের সাথে একই প্রকার চুক্তি করে ফরাসীরা তখন ঘাঁটি থুড়ি বিজনেস হাব গেড়েছে চন্দননগরে আর ওলন্দাজরা চুঁচুড়ায় --- জলপথ সম্বলিত সবই গঙ্গার ধারে।'
'একটি প্রশ্ন করতে পারি?
'করুন।'
'বলছি...... একটি প্রাইভেট ব্যাবসায়িক কোম্পানি কেল্লা বানাতে গেল কোন দুঃখে? যুদ্ধ করে দখলদারি নেবে বলে?'
'এই তো দিব্বি মাথা খুলেছে আপনার। বেড়ে প্রশ্নটি করলেন তো........! আপনি ভাবছেন...... বিদেশি কোম্পানি...... এই ধরুন পেপসি বা কোকাকোলার মতো... এসে বেশ করে অ্যাড-ট্যাড দিয়ে রমরমিয়ে ব্যাবসা করবে...... নাকি কেল্লা বানাবে?'
'হ্যাঁ...... মানে...... ঠিকই ধরেছেন।'
'তাহলে জেনে রাখুন... কোম্পানি এখানে প্রথমে ব্যবসা করতেই এসেছিল......দখলদারি করতে নয়। কিন্তু মুস্কিল সাধলেন চন্দ্রকোনা সাব ডিভিশনের পাঞ্জাবী জমিদার শোভা সিং। বিদেশি কোম্পানিদের অবাধে ব্যাবসা করার মুঘল অনুমতি তিনি মেনে নেননি। এককথায় বলতে পারেন তিনি ওই বিদেশী কোম্পানি এবং মুঘল --- দুইয়ের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ ঘোষণা করেন'।
'বলেন কি মশাই। এ যে আমার - আপনার খুব চেনা গল্প......। এই তো কিছু বছর আগে আমাদের পশ্চিমবঙ্গেই......।'
'একদমই তাই। History repeats by itself। সালটা তখন ১৬৯৫...... আওরঙ্গজেব তখন মারাঠাদের সাথে যুদ্ধে নাজেহাল। আর সেই সুযোগে আফগানদের সাথে হাত মিলিয়ে বাংলায় শুরু হয় শোভা সিং এর বিদ্রোহ। উনি দখল করেন তৎকালীন বর্ধমান এবং ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করেন ওই ব্রিটিশ, ফরাসী বা ওলন্দাজ কোম্পানিগুলির ওপর। পরবর্তীকালে শোভা সিং মারা গেলেও আফগানদের নেতৃত্বে বিদ্রোহ অন্য মাত্রা পায়।'
'আরিব্বাস! এ যে বাংলায় প্রথম বিপ্লব!'
'কতকটা সে রকমই। বলতে পারেন এই প্রেক্ষাপটেই ব্রিটিশ, ফরাসী বা ওলন্দাজ কোম্পানিগুলি নিজেদের রক্ষার্থে কেল্লা তৈরি করতে শুরু করে যথাক্রমে কলকাতায়, চন্দননগরে আর চুঁচুড়ায়। স্যার জন গোল্ডসবোরো আর চার্লস আয়াবের নেতৃত্বে কলকাতায় কেল্লার কাজ শুরু হয় আপনার ডালহৌসি পাড়ায়। এখনকার ডালহৌসি চত্বর মানে ওই জি পি ও, কয়লাঘাট স্ট্রিট থেকে ফেয়ারলি প্লেস...... মানে লালদিঘির উল্টো দিকে স্ট্রান্ড রোড অবধি এই কেল্লা ছিল। কেল্লার প্রধান গেট ছিল স্ট্রান্ড রোডের দিকে।'
'বলেন কি মশাই...। ওইখানে কেল্লা...? গেলবার গরমের ছুটিতে তো ওই ফেয়ারলি প্লেস থেকে ট্রেনের টিকিট কাটলুম আর জি পি ও তে তো এককালে হামেশাই যেতুম। ওই খানে কেল্লা ছিল? মানে সোনার কেল্লা টাইপের...। উফ...ভাবা যাচ্ছে না মশাই।'
'একটু ভুল হল। কেল্লা বলতে আমি আপনি যা বুঝি ফোর্ট উইলিয়াম কিন্তু সেরকমটি ছিল না।'
'মানে?'
'দেখুন অক্সফোর্ড ডিকশনারি ঘাঁটলে আপনি 'কেল্লা' ওরফে 'Fort' শব্দের আর একটি অর্থ পাবেন -- 'The Trading Station'। ফোর্ট উইলিয়াম কতকটা এই ধরনের কেল্লা......। মানে নিরাপদ আশ্রয়ে গঙ্গাপথে ব্যাবসা বাণিজ্য করার বিজনেস হাব'।
'মানে আমাদের সেক্টর ফাইভের মতো...?'
'এইরে...না না... তা নয়। কেল্লার ভেতরে গভর্নর হাউস, থাকার জন্যে দোতলা বাড়ি, দপ্তরী বা কেরানিদের থাকার জন্যে রাইটার্স বিল্ডিং, গুদামঘর, অস্ত্রাগার সবই ছিল। প্রায় পাঁচ বছর ধরে কেল্লার কাজ চলার পর শেষ হয় আপাত ১৭০৬ সালে কিন্তু তারপরেও বেশ কয়েক বছর চলে এই কেল্লা নির্মাণ।'
'বেশ বুঝলাম। ওই জি পি ও টাই আগে কেল্লা ছিল?'
'না না... । এখনকার জি পি ও ভবনটি তৈরি হয় ১৮৬৪ সালে মানে দেড়শ বছর পরে। তবে এটা ধরে নেবেন না যেন যে কেল্লা তৈরি হওয়ার পরেই 'নগর কলকাতা' তৈরি করতে শুরু করে ব্রিটিশরা। তখন 'নগর কলকাতা' বলতে ধান ক্ষেত, তামাক চাষ, কলা গাছ, বাগান, খাল, পাতকুয়া, পুকুর এইসব। পরিবহন বলতে গরুর গাড়ি বা পালকি। কাঁচা এবড়ো খেবড়ো পথ আর রাস্তা বা স্ট্রিট বলতে খান তিনেক। আর ওই কেল্লাটি!'
'কিন্তু তাহলে সেই কেল্লাটি গেলো কোথায়? এক্কেবারে ভ্যানিশ?'
'শুনবেন নাকি গল্পটা? বেশ...... একটা সহজ ব্যাপার বুঝে নিন আগে...... ওই সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে বাংলার রাজনৈতিক অবস্থান মূলত একটি ত্রিভুজের মতো.........যার শীর্ষ বিন্দুতে দিল্লির মুঘল সাম্রাজ্য মানে Central Govt, আর একটি বিন্দুতে কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আর তৃতীয়টিতে মুর্শিদাবাদে মুঘল অধিনস্ত বাংলার নবাবরা মানে State Govt. এই নবাবদের লিস্ট পশ্চিমবঙ্গ মধ্য শিক্ষা পর্ষদের কল্���াণে আমার আপনার খুব চেনা -- মুর্শিদ কুলি খান, সুজা-উদ-দিন, সরফরাজ খান, আলীবর্দি খান এবং তারপর সিরাজ-উদ-দৌল্লা। প্রায় ষাট- সত্তর বছরের ইতিহাস পেরিয়ে এলাম কিন্তু। তখন বাংলার প্রধানতম নগর - মুর্শিদাবাদ, নবাবদের রাজধানী।'
'ওহ... মুর্শিদাবাদ বলতে মনে পড়ল 'ছানাবড়ার' কথা......। উফফ...কতদিন যে খাইনি।'
'ছানাবড়া মনেহয় ওই সমসাময়িক নবাবদের মিষ্টি। এক মণ, দেড় মণের ছানাবড়ার কথাও শোনা যায়। তবে তৎকালীন সময়ে চক্ষু ছানাবড়া করার মতো ঘটনাটি ছিল আউরঙ্গজেবের মৃত্যুর বছর দশেকের মধ্যেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের সূত্রপাত। মানে ঐ দুর্বল কাপ্টেন্সি, দুর্বল রিজার্ভ বেঞ্চ......আর ফলস্বরূপ ঘোড়ি, গজনী আর নাদির শাহদের 'কাউন্টার অ্যাটাকে' পরপর 'গোল'। তারপর ১৮৫�� অবধি কোনওমতে নিজেদের মধ্যে 'পাস খেলে' টিকে থাকলেও...... মুঘল সাম্রাজ্যের পতন সূত্রপাত ওই ১৭২০-৩০ এর পর থেকেই।'
'মানে ত্রিভুজের শীর্ষবিন্দুর পতন?'
'একদম ই তাই......। এবং তার ফলে ত্রিভুজের বাকি দুই বিন্দুর মধ্যে শুরু হয় পেশী শক্তির আস্ফালন, ক্ষমতার লোভ, শাসনের লোভ এবং সর্বোপরি 'আমিত্ব' বোধ। আর এইখানেই ঘুরতে শুরু করে ইতিহাসের চাকা। নিজেদের কূটনীতিক বুদ্ধির জোরে তাদের একসময়ের 'বস'......... মানে ঐ ব্যাকফুটে যাওয়া মুঘলদের একপ্রকার 'হাতিয়ার' করেই কোম্পানির 'ব্যবসাদার' থেকে 'শাসকে' রূপান্তরিত হওয়ার সূত্রপাত। আর তাতে অক্সিজেনের কাজ করেছিল ভারত তথা বাংলার বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যেকার কোন্দল আর ক্ষমতার লালসা।'
'ছক যে মিলে যাচ্ছে মশাই...। এই থিওরিই তো এখনও......।'
'সে আর বলতে। একদিকে সিরাজের গোটা বাংলায় ক্ষমতাসীন হওয়ার নাছোড় মনোবৃত্তি আর অন্যদিকে কোম্পানির ব্যাবসায়িক ও কূটনৈতিক হাতিয়ার ---- সবমিলিয়ে ১৭৫৬ সালে সিরাজের প্রথমে কাশিমবাজার ও তার পরে কলকাতা আক্রমণ এবং ব্রিটিশদের 'সাময়িক' পরাজয়। ওই ডালহৌসি চত্বরের ফোর্ট উইলিয়াম কামান দিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেয় সিরাজের বাহিনী এবং তারপরেই সে কুখ্যাত 'অন্ধ কুপ হত্যা' বা 'Black Hole Incident'।
'ব্ল্যাক হোল? পড়েছিলাম মনে হচ্ছে......।'
'হ্যাঁ... পড়েছিলেন বইকি ইতিহাস বইতে। তৎকালীন কলকাতায় কোম্পানির কর্ণধার হলওয়েল সাহেব সমেত ১৪৫ জন কোম্পানি সৈনিকদের...... একটি গোটা রাত সিরাজের নির্দেশে নাকি বন্দী করে রাখা হয়েছিল একটি অতি সংকীর্ণ ঘরের মধ্যে। শ্বাসরোধ হয়ে মারা যায় প্রায় ১২৩ জন ব্রিটিশ সৈন্য (সংখ্যার হিসেব তর্ক সাপেক্ষ!)।এই নৃশংস হত্যাকাহিনির খবর গোটা ব্রিটেনকে নাড়িয়ে দেয়। এবং সেই রোষেই ব্রিটেন তাদের অন্যতম সেরা কম্যান্ডার রবার্ট ক্লাইভকে পাঠায় কলকাতা পুনরুদ্ধারের জন্য।'
'ঠিক... ঠিক...। এইবার মনে পড়েছে। টীকা আসত...... ৪ নম্বরের।'
'তবে ঘটনাটা কতটা সত্যি... সে নিয়ে মতবিরোধ আছে কিন্তু। বলা হয় যে সিরাজের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করতেই এই ব্ল্যাক হোলের গল্প বানানো হয়েছিল।'
'অ্যাঁ... বলেন কি? ইতিহাস বইতে ভুল ছিল?'
'দেখুন... ভুল বা ঠিক দিয়ে ইতিহাসকে বিচার করতে যাওয়াটা বোকামি। আসলে সেই সময়কার ইতিহাস যতটুকু লেখা হয়েছে...... সব লিখেছেন ব্রিটিশ সাহেবরা। আর তারা কতটা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে লিখেছেন বা লেখেননি...... সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। আর এইটা যেকোনো ইতিহাসের ক্ষেত্রেই সত্যি। তথ্য বা ক্লু এর কোনটা আপনি বিশ্বাস করবেন আর কতটা বিশ্বাস করবেন..... সেটা নির্ভর করবে আপনার যুক্তি নির্ভর মননশীলতা আর বিচারবুদ্ধির ওপর.........মানে বিজ্ঞানীরা যেরকম করেন। ইতিহাসেরও যে একটি বিজ্ঞান আছে মশাই......আর সেখানে আপনিই হোমস...... বা আপনিই ব্যোমকেশ.......। “There is nothing more deceptive than an obvious fact!" .........কি বুঝলেন?'
'কিছুই বুঝলাম না...... বিশেষকরে আপনার এই শেষের কথাগুলোর মাথামুণ্ডু.......। আসলে আমার মাথায় একটা অন্য জিনিস ঘুরছে......।'
'কি?'
'বলছি এই ক্লাইভ কি ঐ দমদমের ক্লাইভ হাউসের ক্লাইভ? মানে আমার শ্বশুরবাড়ি দমদমে কিনা......তাই...।'
'আলবাত... ক্লাইভ হাউসে লর্ড ক্লাইভ থাকতেন। কলকাতার অন্যতম প্রাচীন বসতবাড়ি ওইটি।'
'দমদমে থাকতেন? এত দূরে...? মানে উনি তো এই ডালহৌসি চত্বরের ধারে পাশে কোথাও......। মানে ওই আমলে দমদম-ডালহৌসি ডেলি পাসেঞ্জারির ঝক্কি......। মোটরগাড়িতেও তো অনেকক্ষণ......।'
'বাঃ। দারুণ প্রশ্ন। খুব সম্ভবত ক্লাইভের অধুনা কলকাতা থেকে দূরে থাকার কারণ ছিল কলকাতার দূষিত আবহাওয়া আর প্লেগের মত মারণ রোগের মহামারি। পরবর্তীকালের অধিকাংশ গভর্নর জেনারেলদেরও অধুনা কলকাতার থেকে দূরে মানে গার্ডেন রিচ বা কাশিমবাজারে থাকতে দেখা গেছে। আর মোটর গাড়ি কি বলছেন মশাই? কলকাতায় মোটরগাড়ি আসে ১৮৯৬-এ...... আর তার আগে ছিল ঘোড়ায় টানা ট্রামগাড়ি। তবে ক্লাইভের সময় ঘোড়া গাড়ি, গরুর গাড়ি আর পালকি ছাড়া কোনও অপশন ছিল বলে তো মনে হয় না।'
'বাবাহ... ওসব করে দমদম টু ডালহৌসি ডেলি পাসেঞ্জারি --- সাহেবের এলেম ছিল মশাই।'
'এলেম বলে এলেম। আর সেই এলেমের বশেই ক্লাইভের নেতৃত্বে এক বছরের মধ্যেই ব্রিটিশরা বিখ্যাত 'পলাশীর যুদ্ধে' সিরাজকে হারিয়ে কলকাতা পুনরুদ্ধার করে এবং শুরু হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তৃতীয় ইনিংস ইন বেঙ্গল, ১৮৫৮ অবধি। ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৮, মানে এই একশ বছর কলকাতা হয়ে ওঠে নগর কলকাতা -- ডাক বাবস্থা, আদালত, টাঁকশাল, রাস্তাঘাট নির্মাণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বাবস্থা আরও কত কি। একে একে তৈরি হয়......এই ময়দানের পাশের নতুন ফোর্ট উইলিয়াম, রাইটার্স বিল্ডিং, ওল্ড সিলভার মিন্ট, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং আরও অনেককিছু। ইউরোপিয়ান ঘরানার আদলে সেজে ওঠে নগর কলকাতা।'
'বুঝেছি.........মানে কলকাতায় নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করার পরেই কোম্পানি কলকাতার 'নগরোন্নায়ন' শুরু করে......। কলকাতাকে কেন্দ্র করে ব্যবসায় আরও মুনাফা লুটবে বলে। Investment after assurance। পাক্কা বাবসাদার......।'
'সে আর বলতে......। ব্যবসা মশাই...পুরোটাই ব্যবসা। জানেন কি...ওই সময় ব্রিটেনের এশিয়া থেকে আমদানির দুই তৃতীয়াংশ যেত বাংলা থেকে।'
'আরিব্বাস। বাংলার টাকায় ব্রিটেন চলছে। উফফ......... দারুণ লাগলো ভেবে। তবে আখেরে কলকাতার লাভই হল...... কি বলেন? এই রকম সাজানো শহর ভারতবর্ষে আর কটা আছে বলুন?......... সিটি অফ জয়'।
'সিটি অফ জয়? সে তো ১৯৮৫ তে Dominique Lapierre এর লেখা একটি নভেলের পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু ১৮০০-র গোড়ার দিকে এই শহরকে 'দ্য সিটি অফ জয়' বলা যেত কিনা......আমার ঘোর সন্দেহ আছে। বরং 'দ্য সিটি অফ আফিম' বা 'দ্য সিটি অফ স্মাগ্লারস' বললেও হয়ত অত্যুক্তি হতো না।'
'অ্যাঁ'।
'বুঝলেন না তো। আচ্ছা...... আপনাকে তিনটে ক্লু দিচ্ছি ---- কলকাতা, আফিমের যুদ্ধ আর আলুপোস্ত'।
'অ্যাঁ...... আলুপোস্ত? এবং তার সাথে যুদ্ধ ? এর থেকে বলতে পারতেন চন্দ্রবিন্দুর চ, বেড়ালের তালব্য শ, আর রুমালের মা......।'
'আছে মশাই আছে। বিস্তর যোগাযোগ আছে। আচ্ছা আপনি পোস্ত খান তো?'
'কি বলছেন মশাই! পোস্ত খাবো না? কলাইয়ের ডাল আর আলুপোস্ত আমার হট ফেবারিট। ফি রোববারে ওই দিয়ে এক থালা ভাত খেয়ে দুপুরে একটা ঘুম......... আহা।'
'পোস্ত কি বলুন তো?'
'পোস্ত দানা বলে তো। পোস্ত গাছের বীজ টিজ হবে বোধহয়।'
'আচ্ছা...... পোস্ততে পরে আসছি। আফিম কি জানেন তো?'
'কেন জানব না। নেশা করার জিনিস। আমার ঠাকুরদা......'
'হুম...... তবে আফিম কিন্তু নেশার বস্তু পরে......... আগে একটি ভেষজ ওষুধ। আফিমের চাষ বহু প্রাচীন .........সেই মেসোপটেমিয়ার যুগ থেকে...... ব্যথা কমানোর জন্যে এর ব্যবহার বহুল প্রচারিত ছিল। ধীরে ধীরে আফিম বা আফিমজাত অন্যান্য পদার্থ গুলির বহুল ব্যবহার...... নেশায় পরিণত হয়। আর নেশা কি জিনিস জানেন নিশ্চয়ই......। খাবার নয় ...... পৃথিবীর এক বিশাল গোষ্ঠী তখন এই আফিমের জন্যে পাগল।বিশেষত চিন দেশ। কারণ ওখানে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল। আর সে কারণেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার দখল পাওয়ার পরই কলকাতা ও তার চারপাশে শুরু করে আফিমের চাষ এবং চড়া দামে আফিমের কালোবাজারি শুরু হয় চিন দেশের সাথে। কলকাতা তখন এই ব্রিটিশ কালোবাজারিদের পীঠস্থান......... খুন, হত্যা, রক্তপাত কিছুই বাদ ছিল না এই 'আফিম' বস্তুটিকে কেন্দ্র করে। আর এই কালোবাজারির আপাত সূত্রপাত যার মস্তিকপ্রসুত...... তার নাম ভিনসেন্ট ব্লেক --- জন্ম কলকাতায়। উনিশ বছর বয়স থেকে তুলোর আড়ালে আফিমের কালোবাজারি.........।'
'কি বললেন...... ভিনসেন...। উনিশ বছরের ছোকরা? কিভাবে...... কিভাবে?'
'ছাড়ুন মশাই ভিনসেন্ট কে... সে গল্প অন্য অন্যদিন। তবে এই কালোবাজারির কারণেই ১৮৩৮-১৮৬০ এর দশকে দু দুটো যুদ্ধ হয়ে গেছে চিন ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে। আফিমের বদলে নাকি জাহাজ ভরে রুপো আসত.........সত্যি-মিথ্যে ��ানি না। তাহলে কলকাতার পেছনে ব্রিটিশদের ঢালাও 'উন্নয়নের' কারণটা
কিছুটা বোঝা গেলো কি?'
'তা বুঝলুম বটে...... কিন্তু... আলুপোস্ত'?
'ও হ্যাঁ আলুপোস্ত! ........দেখুন আলু পর্তুগিজদের অবদান আর..... পোস্ত হল গিয়ে ওই আফিম (opium) গাছের ফল থেকে আফিম তৈরি করার পদ্ধতির একটি উপজাত..... যা ফেলে দেওয়া হতো। আর ব্রিটিশদের পাতে তো নৈব নৈব চ।'
'সে কি...... ফেলে দিত? আজ যা ৪৫০ টাকা কেজি...।'
'আজ্ঞে হ্যাঁ স্যর। ব্রিটিশদের ওই ফেলে দেওয়া পোস্ত দানা বেটে পান্তা ভাতে খাওয়া শুরু করল তৎকালীন নিম্ন অভুক্ত বা অর্ধভুক্ত মানুষদের হাত ধরে। আর সেই পাত থেকে আপামর বাঙ্গালীর পাতে পোস্তর উত্থান...... সে আর এক ইতিহাস বটে।'
'বলছি...... মানে ওই আফিমের বংশজাত বলেই কি পোস্ত খেয়ে ওই দুপুরের ভাতঘুমটা ওই রকম জম্পেশ......।'
'সে জানিনা। তবে একথা জেনে রাখুন আজও অনেক দেশে এই আপনার প্রিয়তম পোস্ত নিষিদ্ধ।'
'মশাই...... শেষ প্রশ্ন। হোয়াট আবাউট বাংলার সাধারণ মানুষজন? তাদের ইতিহাসটা...।'
'তাদের কথা আর কোন ইতিহাসে লেখা হয় বলুন ! তারা বোধকরি ওই জাতপাত, ধর্ম আর গ্রাসাচ্ছাদনের তাদিগে ওই ত্রিভুজের মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছে আর গতানুগতিক প্রক্রিয়ায় শোষিত এবং শাসিত হয়েছে। আলিনগর টু কলকাতা.........অলিতে গলিতে তারা ছিলেন এবং এখনও আছেন।'
'আলিনগর?'
'ও হো...... বলতে ভুলে গেছি। প্রথমবার কলকাতা দখল করার পর...... নিজের দাদু অর্থাৎ নবাব আলীবর্দি খানের নাম অনুযায়ী, সিরাজ আমাদের এই শহরটারই নাম রেখেছিলেন আলিনগর।'
**********
অলঙ্করণ ঃ শুভব্রত মজুমদার
0 notes
Text
#হিজিবিজি-৬ ঃ স্যাক্রিফাইস

আজ মনটা দারুণ ফুরফুরে।
ডাক্তারবাবু ঃ নাম?
আমি ঃ অভিজিৎ চক্রবর্তী।
ডাক্তারবাবু ঃ বয়স?
আমি ঃ ফরটি এইট।
ডাক্তারবাবু ঃ বলুন। কি সমস্যা আপনার?
আমি ঃ সমস্যা একটাই। গত কয়েকদিন ধরে একটা মানসিক দ্বন্দ্বে ভুগছি। গা হাত পায়ে ম্যাজ ম্যাজ করছে। হাঁটুতে খঞ্জনি। রাত্রে ঘুম আসছে না...... আর কাজে বেরোতেও ইচ্ছে করছে না।
ডাক্তারবাবু ঃ কবে থেকে?
আমি ঃ গতকাল...... ঐ সন্ধ্যে সাতটা একত্রিশ মিনিটের পর থেকে।
ডাক্তারবাবু ঃ বাবাহ...... আপনি তো দেখছি সময়টাও মনে রেখেছেন।
আমি ঃ সে আমি সব ব্যাপারেই খুব পারটিকুলার। তিন মাস অন্তর অন্তর চেক আপ, রুটিন পরীক্ষা গুলো করিয়ে নিই। রিপোর্টগুলো ফাইলে ডেট অনুযায়ী সাজানো আছে। দেখবেন?
ডাক্তারবাবু ঃ সে দেখবখন। কিন্তু আগে বলুন কি একটা মানসিক দ্বন্দ্বের কথা বলছিলেন না......
আমি ঃ আর বলবেন না। আগামী শুক্কুরবার আমার এক অন্তরঙ্গ বন্ধুর বিবাহবার্ষিকী। সে নেমন্তন্ন করতে এসেছিল গতকাল ঐ সন্ধ্যেবেলায়। বন্ধুটি যেমন খাদ্যরসিক তেমনিই খাওয়াতে ভালবাসে। কয়েক বছর আগে ওর ছেলের জন্মদিনের পাঁঠার মাংস আর ছানার ডালনাটা এখনও মুখে লেগে আছে। উড়িষ্যার এক ঠাকুর আছে তার...... রান্না তো নয়.........অমৃত। আমার গিন্নীর আবার রান্নাটা ঠিক.........ঐ ঢ্যাঁড়স চচ্চড়ি আর চারা পোনার ঝোলের বেশী এগোয়না। তাই.........।
ডাক্তারবাবু ঃ বুঝলাম না। এতে দ্বন্দ্বের কি আছে? নেমন্তন্ন এসেছে...... যান...... কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে আসুন...... ব্যস।
আমি ঃ না মানে......আমার এই মাসের লিপিড প্রোফাইল রিপোর্টটা......... গতকাল বিকেলেই পেয়েছি। দেখুন......
ডাক্তারবাবু ঃ ও বাবা...... কোলেস্টেরল - ২৬৪, ট্রাই গ্লিসারাইড - ১৯০, এইচ ডি এল - ৪২, এল ডি এল - ১৮২। কেলেঙ্কারি কাণ্ড তো।
আমি ঃ সেটাই তো বলছি। কিন্তু...... মানে......ঐ উড়িষ্যার ঠাকুর............। এবারের মেনুতে আবার ঐ পাঁঠার মাংসটা থাকছে...... সঙ্গে তেল কই আর পদ্মার ইলিশ ভাপা। স্পেশাল অর্ডার দিয়ে পদ্মার ইলিশ আসছে আমাদেরই আর এক বন্ধুর মাধ্যমে। কিন্তু এই রিপোর্টের পর............ উফফ...... প্রথমবার জয়েন্ট না পেয়েও এতটা খারাপ লাগেনি।
ডাক্তারবাবু ঃ কি বললেন? পদ্মার ইলিশ? মানে কলকাতায়? কোথায় পাচ্ছেন বলুন তো? সত্যিই...... এখনকার বাজারের ইলিশ গুলো...... নামেই ইলিশ। না আছে ��্বাদ...... না গন্ধ। ইলিশ খেতুম মশাই আমাদের ছোটবেলায়। উফফ...... বাড়িতে রান্না হলে পাড়ার মোড় থেকে গন্ধ পাওয়া যেত। আর স্বাদ...... সে আর কি বলব! মানে...... বলছি...... আপনার ঐ বন্ধুকে দিয়ে যদি একটা দুটো ঐ পদ্মার ইলিশ আমাকেও.........
আমি ঃ সে মনেহয় হয়ে যাবে...... ও আপনি ভাববেন না। কিন্তু আমার সমস্যাটা.........। ইয়ে...... মানে......মনে এইরকম দ্বন্দ্ব নিয়ে কি যাওয়া উচিত?
ডাক্তারবাবু ঃ দ্বন্দ্ব নিয়ে যাবেন কেন? খুশি মনেই যাবেন...... না গেলে আপনার ক্ষতি, আপনার শরীরের ক্ষতি।
আমি ঃ অ্যাঁ...। শরীরের ক্ষতি?
ডাক্তারবাবু ঃ অ্যাঁ... নয় হ্যাঁ। দাঁড়ান...... ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিচ্ছি। আপনি কোলেস্টেরল বাড়ার ভয়ে যাবেন না বলছেন তো। কিন্তু না গেলেও তো কোলেস্টেরল বা��বে।
আমি ঃ অ্যাঁ...... কি করে?
ডাক্তারবাবু ঃ খুব সোজা। যে প্রচণ্ড মানসিক চাপ আপনি বয়ে বেড়াচ্ছেন - সেটার কথা ভেবে দেখেছেন কি? আপনিই তো বললেন যে রাতে আপনার ঘুম হচ্ছে না। সেটা কিন্তু ঐ 'মানসিক চাপের' জন্যেই। বলছি...... গতকাল থেকে গিন্নীর সাথে ভালো করে কথা বলেছেন কি?
আমি ঃ ধুর...... গিন্নী কেন...... কারোর সাথেই বলিনি। আমার বারো ক্লাসে পড়া মেয়েটাকে আজ সকালে প্রায় অকারণেই প্রচণ্ড বকুনি দিলাম। এমনিতে আমি বকা ঝকা বেশী করি না জানেন...। তারপরে এক দু কথায় গিন্নীর সাথেও লেগে গেলো......।
ডাক্তারবাবু ঃ তাহলেই বুঝুন। সব কিছুর মুলে কিন্তু ঐ চাপ বা স্ট্রেস.........। এনাদের উপক্রমেই আপনার মস্তিষ্কের ঐ হাইপথ্যলামাস থেকে বেরোচ্ছে আড্রিনালিন আর করটিসল নামের দুই হরমোন। আর এই দুই হরমোনের তাড়নায় চড়চড় করে তৈরি হচ্ছে লো ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন অর্থাৎ এল ডি এল......। আর এই এল ডি এলের অ-'কল্যাণে' আপনার আরটারি ব্লকেজ অর্থাৎ অ্যাথেরোস্কেলেরোসিস আর হার্ট রেট বৃদ্ধি। আর ক্রমাগত যদি এই রকম পদ্মার ইলিশ, পাঁঠার মাংস 'মিস' করার স্ট্রেস আপনি নিতে থাকেন তাহলে আপনার জীবনে পরপর আনজিনা পেক্টরিস, হাই ব্লাড প্রেশার, কারডিও ভ্যাস্কুলার ব্যারাম আর সবশেষে ব্যাপারটা স্ট্রোক অবধিও গড়াতে পারে। আর করটিসল আবার অন্যদিকে আপানার ব্লাড সুগারটিও যে বাড়িয়ে দেবে...... মানে হাইপারগ্লাইসিমিয়ার চান্সও বেড়ে গেল আপনার।
আমি ঃ বলছেন?
ডাক্তারবাবু ঃ দাঁড়ান...... শেষ হয়নি। এই মানসিক চাপের জন্যে শরীরের বেশীর ভাগ এনার্জি কাজে লাগানো হবে আপনার হার্টে, ব্রেনে আর অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গে। ফলে মুশকিলে পড়বে আপনার পাচন শক্তি...... ফলে ক্রনিক কন্সটিপেশন আর ইরিটেবল বাওএল সিন্ড্রোম। মানে ঐ ঢ্যাঁড়স চচ্চড়ি আর চারা পোনার ঝোল হজম করতেও আপনার কালঘাম ছুটবে। মোদ্দা কথা......ঐ পদ্মার ইলিশ, পাঁঠার মাংস, তেল কই বা এই রকম আরও অনেক কিছু বাদ দ���ওয়ার মানসিক স্ট্রেস থেকে আপনার স্ট্রোক বা ডায়াবিটিস এমনকি হয়ত ডিভোর্স অব্দিও ঘটে যেতে পারে।
আমি ঃ হুম। মানে কোনও ওষুধ......?
ডাক্তারবাবু ঃ ওষুধ - ফসুধে কিস্যু হবে না......... শুধু মার্ক টোয়েনের ঐ উক্তিটা দুপুরে ও রাতে খাওয়ার আগে একবার করে আউরে নেবেন -- 'The secret of success in life is to eat what you like and let the food fight it out inside.'
(নাহ...... আর কোনও দ্বন্দ্ব নেই। চটজলদি আয়নার সামনে থেকে সরে এলেন ডঃ অভিজিৎ চক্রবর্তী। হাতে সময় আর মাত্র আধ ঘণ্টা। অন্তত নিজের ডিভোর্স আটকানোর জন্যে বন্ধুর বিবাহবার্ষিকীতে যাওয়ার 'স্যাক্রিফাইস' টা যে করতেই হবে তাঁকে।)
0 notes
Text
#হিজিবিজি -৫ ঃ ফেলু

আজ মনটা দারুণ ফুরফুরে।
আমার নাম প্রদোষ চন্দ্র মিত্র। আমার নামটা শুনে আপনি যার কথা ভাবছেন আমি আদপেই তিনি নই। মিত্রবাড়িতে আমার জন্মের পর হয়ত অনেক আশা ভরসা করে আমার জ্যাঠামশাই আমার ঐ নাম রেখেছিলেন কিন্তু..... আজ সেই 'নাম'-ই' আমার জীবনের প্রধান অন্তরায়। ছাত্র হিসেবে আমি ছিলাম মধ্যমানের...... কিন্তু মানুষ হিসেবে আমি একেবারে অতিসাধারণ। আমার স্ফীতকায় মধ্যস্থল, রোগাটে হাত-পায়ের গড়ন, বাঁধাকপির পাতার মত দুটো কান আর শালগমের মত নাক। আমি নিজের খেয়ালে রাস্তা পার হতে গিয়ে রাস্তার লোকেদের মুখ ভেংচানি খাই, ফুটপাথে পড়ে থাকা সামান্য মাটির ভাঁড়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাই, বাসে আমার পাশে দাঁড়ানো লোকটি লাফিয়ে আমার সামনের সিটটি দখল করলেও কিছু বলতে পারিনা, রিকশাওয়ালা দশটাকার ভাড়া পনের টাকা চাইলেও তর্কে যাই না। কি হল? মজা পাচ্ছেন? সে তো আপনি পাবেনই। এই আপনাদের মত যারা ঐ 'আসল' প্রদোষ চন্দ্র মিত্রকে জানেন, চেনেন...... তাদের ঠোঁটের কোণের ঐ ব্যাঙ্গরেখা বা আপাত কিছু টোনকাটা ফুটনোটে আজ আমার এই আটত্রিশ বছরের জীবন সম্পূর্ণভাবে 'নকল'। নিজের পরিচয় দেওয়াটাই এখন দায় হয়ে উঠেছে আমার কারণ আমি আক্ষরিক অর্থেই 'ফেলু' এবং এই 'ফেলু' কোনভাবেই '��্রদোষ চন্দ্র মিত্র' নয়। অনেকদিনই হাওড়া ব্রিজের ঠিক মধ্যেখানে দাঁড়িয়ে এই 'নকল' জীবনটাকে শেষ করে দেওয়ার কথা ভেবেছি। কিন্তু এই পিতৃপুরুষের দেওয়া নামটিকে বদলে ফেলার সৎসাহসই যার নেই সেই আহা���্মক আত্মহত্যা করার মত সাহস জোটাবে কোত্থেকে? সেই হাওড়া ব্রিজেই দাঁড়িয়ে আছি আমি এখন। পেছনের ব্রিজে এখন তুমুল জ্যাম। সেই অফিস পাড়া থেকে হাঁটতে হাঁটতে আসছি আমি -- আর সঙ্গে ঐ ভদ্রলোক। যার গত আধঘণ্টার বকবকানি কানে বাজছে এখনও। ভদ্রলোক আমার মুখচেনা। অফিসে আগেও এসেছেন। আমারই পাশের টেবিলের সুবিনয়বাবুর ক্লায়েন্ট। আমি হাওড়া যাব শুনে উনি সঙ্গ নিলেন। বললেন -- 'হেঁটেই যেতে হবে স্যর। হাওড়া ব্রিজে লরি উলটেছে। বিশা-আল জ্যাম।' ভদ্রলোকের মাথায় কাঁচা পাকা চুল, পরনে ঢোলা পায়জামা, গায়ে আধময়লা পাঞ্জাবী আর মুখে জর্দা মেশান পানের গন্ধ। বয়স আনুমানিক আমারই মত। ভদ্রলোক বেশ জোরেই হাঁটেন আর অনর্গল কথা বলতে পারেন। বলছিলেন - 'এসেছিলাম দোকানটার একটা বিমা করাতে। মল্লিক ঘাট ফুল মার্কেটে আমার দোকান। কে জানে স্যর এরা কবে আবার এই মার্কেটে আগুণ ধরাবে। তখন তো হাতে একেবারে হ্যারিকেন। সুবিনয়বাবুর দয়ায় বিমাটা হয়ে গেলে তারাপীঠে পুজো দিয়ে আসব স্যর'। স্ট্রান্ড রোডের মুখে তখন সামনে সিগন্যাল লাল হতে আর ১২ সেকেন্ড বাকি। ভদ্রলোক হেঁচকা টানে আমার হাত ধরে প্রায় টেনে নিয়ে রাস্তা পার করিয়ে বললেন -- 'কিছু মনে করবেন না স্যর। ৫ টা ৩২ এর লোকালটা ধরতেই হবে।' রাস্তার ওপারে আপাত স্বস্তি... শয়ে শয়ে লোকের সাথে পা মিলিয়ে এগোচ্ছি আমরা। আবার বললেন ভদ্রলোক - 'দেখেছেন... এতক্ষণ বকবক করছি...... আমার পরিচয়টাই দেওয়া হয়নি। আমার নাম পোদোস চন্দ্র মিত্র স্যর। বাড়ি মানকুণ্ডুতে।' ফুটপাথে ভাঁড় ছিল না বোধহয় --- এমনিই হোঁচট খেলাম আমি। ভদ্রলোক বলেই চলেছেন - 'জানেন তো স্যর... আমার নামে নাকি এক হেব্বি ফেমাস হিরো আছে। কিসব বই-ফই ও নাকি আছে। সেই হিরোর নাকি সিনেমাও বেরোয়। ভাবুন কাণ্ড। এক মামুলি ফুল কারবারির নামে হিরো? হা হা।' কয়েক সেকেন্ডের নিঃশব্দ বিরতির পর অদ্ভুত ভাবেই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল -- 'কই...... জানি না তো।' 'পোদোস' বাবু উত্তরে পানের পিক ফেলে বললেন --'আছে স্যর। আমার ফুলের দোকানের ছেলেটা খুব সিনেমা দেখে। সেই বলল। আমি আর বইপত্রের কি বুঝি বলুন। তবে কি জানেন...... আমিও মামুলি লোক নই স্যর। ফুল মার্কেটে কাউকে বলবেন 'মিত্রদার' দোকানে যাব। হাতধরে নিয়ে যাবে। কলকাতার বড় বড় অনুষ্ঠানে, ব��য়েবাড়িতে আমার দোকান থেকেই ফুল যায়। টিউলিপ আর অর্কিডের এত রকম বাহারি কালেকশন আপনি আর কোথাও পাবেন না স্যর। গত বছর লন্ডনেও ফুল গেছে আমার দোকান থেকে। লাগলে বলবেন। আমারা ছেলেরা আপনার বাড়ি দিয়ে আসবে।' ততক্ষণে আমরা হাওড়া ব্রিজের মুখে। ভদ্রলোককে বললাম -'আপনি এগোন। আপনার তাড়া আছে।' এগিয়ে যেতে যেতে ভদ্রলোক বলে গেলেন --'চলি স্যর। আপনি আস্তে আস্তে আসুন। একদিন দোকানে আসবেন...... আর নামটা মনে রাখবেন স্যর - পোদোস চন্দ্র মিত্র।' সেই তখন থেকে জানিনা কতক্ষণ হয়ে গেল একরাশ মানুষের ধাক্কা খেতে খেতেই হাওড়া ব্রিজের ঠিক মধ্যেখানে দাঁড়িয়ে আছি আমি। সম্বিৎ ফিরতেই বুকপকেটে রাখা দু টাকার কয়েনটাকে ক্যরামের ঘুঁটির মতন টোকা মেরে ওপর থেকে উড়িয়ে দিয়ে হাওড়া স্টেশনের পথে পা বাড়ালেন 'পোদোস থুড়ি প্রদোষ চন্দ্র মিত্র'।
0 notes
Text
#হিজিবিজি-৪ ঃ ম্যাও

আজ মনটা দারুণ ফুরফুরে।
আমি বিল্টু মানে শ্রীসাম্য সরকার, আজ সকালথেকে খুব হ্যাপি। এই 'হ্যাপি' বানানটাও আমি এখন জানি -- এইচ এ পি পি আই। আগে ওই 'আই' এর জায়গায় 'ওয়াই' লিখতাম। 'আই' মানে আমি আর আমি মানে 'হ্যাপি'। আমাকে অনেকে গিফট দেয়...... কিন্তু আজ আমি প্রথমবার কাউকে গিফট দিয়েছি -- তাই আমি আজ খুব হ্যাপি। আমার বয়স সাড়ে নয়। আমি সারাদিন বাড়িতেই থাকি..... এঘর ওঘর ঘুর ঘুর করি...। স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম জানো...... কিন্তু ওরা আমাকে কয়েকমাসের মধ্যেই বাড়িতে পাঠিয়ে দিল। বলেছে...... আমি নাকি 'ডিসেব্লড চাইল্ড'...... 'অটিসম' নাকি কি একটা রোগ আছে নাকি নাকি আমার। আমি 'পটি' বুঝি...... কিন্তু ওই 'অটিসম' 'টটিসম' কিছুই বুঝি না। আসলে আমি বুঝি অনেককিছুই কিন্তু বোঝাতে পারিনা কাউকে। বাবা, মা আর দাদুর থেকে বাংলা, ইংরেজি শিখেছি। পড়তেও পারি দিব্বি। এই তো গত মাসে আমার বার্থডে ছিল। মা একটা দারুণ স্ট্রবেরি কেক বানিয়েছিল। আমি এটাও জানি যে স্ট্রবেরি-র নাম স্ট্রবেরি হলে কি হবে -- ওটা আদপেই কিন্তু 'বেরি' নয়। অবাক হলে তো......। এটা আমি শিখেছি বাবার বুকশেলফে রাখা একটা মোটা বইয়ের থেকে। নামটা কি 'ব্রিটানিয়া' না কি যেন একটা! আমার প্রিয় রং কি জানো? - প্রুশিয়ান ব্লু। আর প্রিয় ��েশ? - নাউরু। আর প্রিয় পাখি? -স্ট্রিগিফরমেস। এগুলো তোমাদেরকেই বললাম। এমনিতে আমি ভালো করে কথা বলতে পারিনা যে। আমার কথা তাই কেউই বোঝে না। তখন আমার কিন্তু খুব রাগ হয়। আমি কিন্তু তোমাদের সবার কথা বুঝি। তবে সব কথা যে বুঝি তা নয়। তোমরা মাঝে মাঝে কিসব কঠিন কঠিন শব্দ বল - সেগুলো বুঝি না। এই সেদিন দেখলাম সবাই মিলে দাদুকে কোথায় যেন নিয়ে গেল। দাদু ঘুমচ্ছিল। আচ্ছা ঘুমের মধ্যে ওই রকম ভাবে কাউকে নিয়ে যেতে আছে -- ঘুম ভেঙে যাবে না? একজন বলছিল - 'হার্ট আট্যাক'। আমি হার্ট মানে জানি -- ওই যে 'লাল রঙের হয়...... তলায় লেখা থাকে 'লাভ''...... আর আট্যাক মানে তো 'যুদ্ধ'। তা 'লাল রঙের ওইটার সাথে যুদ্ধ কি করে এলো' ব্যাপারটা বুঝিনি। দাদু কিন্তু দিব্বি ঘুমচ্ছিল -- একটুও নড়েনি। কিন্তু জানো-- তারপর থেকে দাদু আর বাড়িতে ফেরেনি। আমার খুব রাগ হয়েছিল। রাগের মাথায় দাদুর ঘরের কিছু জিনিস বাইরে ছুঁড়ে ফেলেছি -- যদি সেসব নিতে দাদু আসে। কিন্তু দাদু আসেনি। মা বোধহয় আমার রাগটা বুঝেছিল। আমাকে বলল -- 'দাদু নাকি গডের কাছে চলে গেছে'। এই 'গড' ব্যাপারটাও বুঝিনি। ওই 'ব্রিটানিয়া' বইটাতেও 'গড' বলে কিছু খুঁজে পেলাম না। এবার আজকের সকালের ঘটনাটা বলি শোনো। সকাল থেকেই আমাদের বাড়ির গলিতে দুটো বেড়ালের সে কি ঝগড়া - একটা মেনি আর একটা হুলো। মেনিটাই বেশী চেঁচাচ্ছে। সকাল থেকে ওদের জ্বালায় মা অস্থির। দু বার তাড়িয়েও কোনও লাভ হল না। দিদা বলল 'বেড়ালের ঝগড়া নাকি অলুক্ষনে...... বাড়ির অমঙ্গল হয়'। কিন্তু আমি ওপরের বারান্দা থেকে মিনিট পাঁচেক ওদের ওই 'ঝগড়া' শুনে বুঝলাম -- ওটা একেবারেই ঝগড়া নয়। আজ ওই মেনি বেড়ালটার 'হ্যাপি বার্থডে' আর ওই চেঁচানিটা হলে আসলে 'আবদার' তার বাবা মানে ওই 'হুলোটার' কাছে। বায়না জুড়েছে একটা মাছ এনে দেওয়ার। এ রকম তো আমিও করি। সেদিনও রাস্তায় শুয়ে গড়াগড়ি দিয়েছি চিপসের জন্যে -- অনেকেই বোঝে না যে। মা বোঝে -- কিন্তু সেদিন আমাকে কিনে দেয়নি। কিন্তু 'হ্যাপি বার্থডে'র দিন তো ছোটদের সব আবদার মেটাতে হয়। কিন্তু বেচারা 'হুলো' টাই বা মাছ পাবে কোথায়? একছুটে রান্নাঘর থেকে একটা মাছ এনে বারান্দা থেকে ছুঁড়ে দিয়েছিলাম গলিতে। সে যদি মেনির খাওয়াটা দেখতে। খাওয়ার শেষে ওপরে আমার দিকে তাকিয়ে একবার বলল 'ম্যাও' -- আমি জানি ওটার মানে 'থ্যাঙ্ক ইউ'।
0 notes
Text

হিজিবিজি #৩ ঃ বাউন্সার
আজ মনটা দারুণ ফুরফুরে। গত কয়েক মাসের মধ্যে জীবনটা যে এভাবে পালটে যাবে বুঝিনি। চাকরি থেকে বাকরি, বিষয় থেকে আশয়, মানসিক থেকে শারীরিক – সব ব্যাপারেই জীবনটা পুরো ‘চিকেন চাপ’ বা ওই 'ঘেঁটে ঘুগনি'। কিন্তু আজ সকালে সব সমস্যার সমাধান একবারে পেয়ে গেছি। মনে মনে একটা ঝিঙ্কু নাচ দিলাম এক্ষুনি। এবার এক এক করে সব ব্যাটার থোঁতা মুখ ভোঁতা করব। পড়াশুনো তো বিশেষ হয়নি…… ক্রিকেটই আমার সব। আমি ফাস্ট বোলার – ১৪০ কিমি/আওয়ার— সাউথ ক্যলকাটায় যেকোনো বড় টুর্নামেন্টে সবাই আমাকে এক ডাকে চেনে – 'বুবান দ্য বাউন্সার'। ইচ্ছে ছিল একটা ক্রিকেট কোচিং সেন্টার খোলার। হল না বুঝলেন। একটা ব্যাঙ্ক লোণ নিয়েছিলাম। কিন্তু কিছু বাজে লোকের পাল্লায় পড়ে টাকাটা মার গেল। এখন ব্যাঙ্কের নতুন ম্যানেজার এসে গুণ্ডা পাঠিয়ে আমাকে থ্রেট দিচ্ছে। মাস তিনেকের মধ্যে টাকাটা না দিলে বলেছে পুলিশ লাগিয়ে জেলে ঢোকাবে। ওই টাকার মাত্র লাখ আড়াই মত পড়ে আছে আমার কাছে। একটা জিমে পার্ট টাইম ট্রেনারের কাজ করে বাকি টাকা কোথা থেকে জোগাড় করব জানিনা। আর রয়েছে - সঙ্গীতা…… মানে আমার ভাবী বৌ! ওই জিমেই প্রথম আলাপ। ধুর… আর 'বৌ’ ই বা বলছি কেন…! বিয়েটা তো আর মনে হয় হবে না। দুবছর ধরে প্রেম করছি জানেন। সেদিন সঙ্গীতার বাড়ির লোক ডেকে যাচ্ছেতাই অপমান করল আমাকে। বলেছে - বছর খানেকের মধ্যে একটা চাকরি না জোগাড় করলে ওসব বিয়ে ফিয়ে ভুলে যেতে……। সব শুনেও একটা কথাও বলেনি সঙ্গীতা। চাকরির চেষ্টা যে আমি করিনি তা কিন্তু নয়। পাড়ার শৈবাল দা…… ওই পার্টি ফারটী করে আর কি…… বলেছে… লাখ দুয়েক টাকা ফেললে 'চাকরি’ হয়ে যাবে স্পোর্টস কোটায়। নয়ত পার্টির কাজ করতে বলেছে। পার্টির কাজ মানে তো বোঝেনই – ওই তোলা আদায়, মিটিং মিছিলে পাবলিক খেদানো, নেতা মন্ত্রীদের পিছু ঘুর ঘুর করা, মাঝের মধ্যে একটু গরমা গরমি হলে ক্যালানি থেকে পেটো…… এই আর কি। আমি খেলোয়াড় মানুষ দাদা……….আজ অব্দি সিগারেট, বিড়ি, মদ – কিচ্ছু খাই নি…… এসব কাজ আমার দ্��ারা হবে না। এসবের মধ্যে শরীরটাও বেগরবাই করছিল কয়েক মাস ধরে। মাসল ক্রাম্প, জ্বর, জয়েন্ট পেইন, নিঃশ্বাসে সমস্যা…… এগুলো তো ছিলই – গা করিনি। রান আপ কমিয়ে বল করছিলাম। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার টালিগঞ্জে একটা টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালের ম্যাচে আমি একেবারে ব্ল্যাক আউট। ওরাই ভর্তি করে হাসপাতালে। আর সেই থেকে আমি এখানে –। শুয়ে থাকি আর ওই ডেডলাইন গুলোর কথা ভাবি – কারোর ছয় মাস, কারোর এক বছর……। আজ ডাক্তার দিলেন আমার 'ডেড’-লাইন – 'চার থেকে পাঁচ মাস'। চোখ বন্ধ করে বসে ছিলাম কিছুক্ষণ। মাথায় ঘুরছিল একটা স্কোরবোর্ড। লেখা ছিল 'শ্রী সমর গাঙ্গুলি ওরফে 'বুবান দ্য বাউন্সার’ এল বি ডবলু লিউকোমিয়া মানে ব্লাড ক্যান্সার। আর অন্য দিকে ওই ব্যাঙ্ক বা সঙ্গীতার বাড়ির লোক বা ওই পার্টির দাদা – সবাই ক্লিন বোল্ড উইথ এ গোল্ডেন ডাক।’ ডাক্তারবাবু বলে যাচ্ছিলেন নেক্সট চিকিৎসার কথা – কিন্তু আমি জানি ও টাকা আমাকে পাঁচ বার বিক্রি করলেও হবে না। আর ব্যাঙ্কে থাকা ওই টাকা গুলো……… এই হাসপাতালের পিছনে গুঁজে ওই 'এক দু’ মাস এক্সট্রা ব্যাটিং করতে আমি চাই না। আমার দরকার কেবল দু মাস– সামনের মাসে ইন্ডিয়া যাচ্ছে ইংল্যান্ডে। পাঁচটা টেস্ট, তিনটে ওয়ান ডে আর একটা টি টোয়েন্টি সিরিজ। উফফফ সেই এজবাস্টন, ওভাল, লিডস আর 'দাদার’ সেই লর্ডস। আপনারা না জানলেও আমি জানি যে আমার ডেলিভারিটা 'নো বল’ ছিল অর্থাৎ এই আগামী চার থেকে পাঁচ মাস আমার 'ফ্রি হিট’…… আউট হওয়ার আর কোনও চান্সই নেই। এখন মনের সুখে লর্ডসের মাঠে জামা খুলে ওড়াতে পারি আমি……।
1 note
·
View note
Text
হিজিবিজি #২ : সারপ্রাইজ
আজ মনটা দারুণ ফুরফুরে।
আইডিয়াটা পাওয়ার পরই মিতালিকে জানাই। মিতালির যা স্বভাব -- জানতাম বেঁকে বসবে। এবং হলও ঠিক তাই। একরাশ কথা...... এদিক ওদিককার যুক্তি...... লোকলজ্জার ভয়...... আরও কত কি! আমার মনেও যে একেবারে দ্বন্দ্ব ছিল না...... তা নয়। নিয়ম মেনে চলাই আমাদের জীবনের প্রধান ধর্ম...... আর নিয়ম ভা��া সেখানে এক গর্হিত অপরাধ। কিন্তু গত কয়েক দিনে বেশ কিছু ঘটনায়..... মনে একটা 'নিয়ম ভাঙার' জেদ চেপেছে...... । তাই মিতালির বারণে কান দিইনি। নিকুচি করেছে লোকজনের --- দুদিন বলবে --- তারপর ভুলে যাবে। মনকে ঝেড়ে ফেলে আজ সকালবেলায় কথামত পাড়ার মোড়ের বাস স্ট্যান্ডে আমি যখন পৌঁছই তখন ঘড়িতে পাঁচটা চল্লিশ। মিতালি তার 'নিয়মমাফিক' লেটের ধারা বজায় রেখে এলো প্রায় কুড়ি মিনিট পরে। আজ আর রাগ দেখিয়ে লাভ নেই। 'হ্যাপি বার্থডে ম্যাডাম' -- বলে মিতালির দিকে এগোতেই, মিতালি ফিরে গেল সেই মিতালিতেই -'উফফ...... কি যে তোমার পাগলামি বুঝি না। কাল সারারাত প্রায় ঘুমোতে পারিনি। একটু বলবে...... আমরা কোথায় যাচ্ছি'? বললাম - 'না বলব না। পুরোটাই সারপ্রাইজ থাক না'। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই একটা ট্যাক্সি...... আমাদের প্রথম গন্তব্যস্থল এয়ারপোর্ট। এয়ারপোর্টে আমি আগে এলেও... মিতালির প্রথমবার। স্পট বুকিং এর কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে, ব্রেকফাস্ট করে আমরা যখন বাগডোগরার প্লেনে তখন ঘড়িতে আটটা চল্লিশ। প্লেন ছাড়বে ঠিক নটায়। মোবাইল ফোন সুইচ অফ করার দরকার নেই কারণ ওটা সুইচ অন করিনি আমি। বাগডোগরায় নেমে প্রথমেই একটা গাড়ি বুক করলাম -- গন্তব্যস্থল 'লাটাগুরি'। অবশ্য তার আগে লোকাল মার্কেট থেকে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা। এক রাত্তির থাকার মত কোনও জিনিসপত্রই যে আনিনি আমরা। সব শেষ করে লাটাগুরি পৌঁছোতে বেজে গেল প্রায় আড়াইটে। ড্রাইভার ছেলেটি বেশ ভালো। আমাদের হোটেল বুকিং নেই শুনে -- সে নিয়ে গেল তার বাড়ি। সাধারণ হোম স্টে...... কিন্তু আমাদের কাছে 'অসাধারণের' থেকেও অনেক বেশী। সেদিন থেকে পরদিন সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ফেরার অবধি অংশ টুকু একান্তই ব্যক্তিগত - তাই আর বেশী লিখে কাজ নেই। অল্পকথায় ওই মিতালির প্রথমবার এরোপ্লেনে চড়া, অন্ধকার জঙ্গলের ঝি ঝি পোকার ডাক, গভীর রাতে দুজনে মিলে একসাথে বারান্দায় বসে জঙ্গলে বৃষ্টি দেখা আর এক আকাশ নিস্তব্ধতা --- মিতালির জন্মদিনের সারপ্রাইজ। অবশ্য কলকাতায় ফেরার পর সে 'নিস্তব্ধতা' যে আপত্তিজনক 'বিস্ফোরণে' পরিণত হয়েছিল সেটা বলাই বাহুল্য। ব্যাপারটা থানা পুলিশ অবধি গড়ায়। উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি আমি কাউকেই। বিশেষ পাত্তা দিইনি কোনকিছুই। এত দিন তো কত কিছুই তো পাত্তা দিয়ে এলাম -- একদিনের জন্যে নিয়ম ভাঙব না। আর এবয়সে যদি নিয়ম না ভাঙ্গি...... আর কবে ভাঙব। বয়স তো কিছু কম হল না। ছেষট্টি বছর বয়সী আরণ্যক ��ৌধুরীর তার একচল্লিশ বছর আগে বিয়ে করা স্ত্রী শ্রীমতী মিতালি চৌধুরীর সাথে নিজের মত করে একটা দিন কাটানোর জন্যে কারোর পারমিশনের দরকার আছে নাকি? ছেলে- বৌমাদের বেশী ঘাঁটিয়ে লাভ নেই -- তারা চলুক তাদের মত -- আর আমরা চলব আমাদের মত। একমাত্র ব্যতিক্রম - সোমক। মানে সম্পর্কে আমাদের নাতি -- কিন্তু এক কথায় আমার 'আঙ্কেল ডাম্বলডোর'। ঠাকুমার জন্মদিন পালনের এ হেন প্ল্যানটা যে তার মাথা থেকেই বেরিয়েছিল।
0 notes
Text
হিজিবিজি #১ ঃ বিপ্লবী
আজ মনটা দারুণ ফুরফুরে।
আমার নাম - রজতেন্দ্র বসু। আজ আমার মাধ্যমিকের ফলাফল বেরিয়েছে। জোর বেঁচে গিয়েছি আমি। আমি ইংরেজিতে একশোতে সাড়ে সতেরো পেয়েছি। স্কুলের ইতিহাসে ইংরেজিতে এত কম নম্বর নাকি আর কেউ মাধ্যমিকে পায়নি। খুব ভালো করে জানি যে কোনও এক ছাত্রদরদী মাস্টার আমার খাতা দেখেছেন বলেই এই নম্বর। ঐ খাতায় কোনভাবেই সাতের বেশী নম্বর পাওয়ার কথা নয়। কারণ --- প্রথম প্রশ্নের উত্তরে আমি এঁকেছিলাম একটি কুঁড়েঘর। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে আমি এঁকেছিলাম ঈষৎ বাঁকা দুটি নারকেল গাছ। তৃতীয় প্রশ্নের উত্তরে তিনটি নৌকা। এমন করে যখন সপ্তম প্রশ্নে অনেকগুলো পাহাড়ের পেছনে সবে সুজ্জিমামা উঁকি দিচ্ছেন তখন পেছন থেকে টোকা -- 'চার নম্বর প্রশ্নের উত্তরটা কি রে?' ঘার ঘুরিয়ে প্রাণের বন্ধু সূর্যকে চার নম্বরের 'উত্তরটা' দেখালাম। সে ব্যাটা তো প্রায় ভিরমি খায় আর কি। শেষে তারই অনেক জোরাজুরিতে 'কর্ণপাত' করে গ্রামারের সাতটি প্রশ্নের উত্তর লিখতে হয় --- সে খাতার শেষ পাতায়। কিন্তু ততক্ষণে আমার 'বিপ্লব' খাতা জুড়ে। 'বিপ্লব' --- আহা বুঝলেন না। আমি তো সেই ছোটবেলা থেকেই 'বিপ্লবী' -- ইংরেজদের প্রতি এবং অবশ্যই 'ইংরেজির' প্রতি। এর জন্যে দায়ী আমার ঠাকুরদা। তিনি ছিলেন প্রাক স্বাধীনতা আমলের এক বিপ্লবী। আর সেই গল্পই তিনি করতেন আমার কাছে -- সেই বোমা বাঁধা, গোপন মিটিং, নেতাজি, পুলিশের তাড়া, ডুব সাঁতারে ইছামতী নদী পারাপার, হাজতবাস, ধনধান্যে পুষ্পে ভরা...... আরও কত কি। আমার কাছে আমার ঠাকুরদা তখন 'হিরো' আর আমি তার অনুগত সৈনিক। উনি বলতেন -- 'তোর বাবা একখান দেশদ্রোহী। অমন সাহেবি আদব কায়দা...... মুখে অনর্গল ইংরেজিতে বুলি...... যাকে বলে এই 'বসু পরিবারের' কুলাঙ্গার।' যদিও বাবার সামনে বিশেষ ট্যাঁ ফো করতে দেখিনি ওনাকে। উনি ওনার নিঃশব্দ 'বিপ্লব' চালাতেন আমার মধ্যে দিয়ে। ওনার কথাতেই বাবার সাধের পাইপটা আমি আমাদের বাড়ির পেছনের পুকুরের জলে ফেলে দিয়েছিলাম। ধরাও পড়ি -- বিস্তর ঠ্যাঙ্গানিও জোটে বাবার কাছে। দাদু বলেছিলেন বিপ্লবীদের জীবনে এটা জলভাত। শেষমেশ সেই বিপ্লব এসে পড়ে আমার পরীক্ষার খাতায়। স্কুলে আমাদের ইংরেজি পড়াতেন শশাঙ্কবাবু। আমার বাবার অনুরোধেই উনি আমার ইংরেজির 'উন্নতিসাধনে' বাড়িতেও পড়াতে আসতেন। শশাঙ্কবাবুর বদান্যতাতেই হয়ত স্কুলে এতদিন আমি ইংরেজিতে আমি 'ফেল' করিনি। আমার 'বিপ্লবী' মনোভাবে শশাঙ্কবাবু ছিলেন ইংরেজদের 'বিশ্বস্ত অনুচর'। সেই অপরাধে ওনার সাইকেলের হাওয়া খুলে দিয়েছি বার কতক। আজ রেজাল্ট পেয়ে শশাঙ্ক বাবু একঘর ছেলেদের সামনে আমাকে গালমন্দ করছিলেন তখন আমার চোখ দিয়ে জল পড়ছিল। লোকে ভেবেছে আমি দুঃখে কাঁদছি। আমি কাঁদছিলাম --- ঐ ব্রিটিশদের একটা সমুচিত জবাব দেওয়ার আনন্দে......। ফিটন গাড়ি চেপে আসা লিটন সাহেবের ওপর বোমা মারলেও হয়ত এত আনন্দ হত কিনা জানিনা। আমি 'বিপ্লবী'......আমার বিপ্লব চলছে...... চলবে। কিন্তু ঐ অতিরিক্ত সাড়ে দশ নম্বর আমি কোত্থেকে পেলাম......সেটা আজও এক রহস্য।
0 notes
Text
আলমগীরের দরবারে
তথ্যকেন্দ্র ও উত্তরবঙ্গ সংবাদের শারদাঞ্জলি - ২০১৮ তে প্রকাশিত
'टोपियों की सिलाई करके मैंने चार रूपये दो आने जमा किये हैं। यह रक़म महालदार लाइलाही बेग के पास जमा है। इस रक़म से मुझ गुनहगार पापी का कफ़न ख़रीदा जाय।'
উপরের বাক্যের বাংলা তর্জমা করলে মোটামুটি দাঁড়ায় ঃ 'টুপি সেলাই করে আমি চার টাকা দু আনা পয়সা জমিয়েছি। মহলদার লাইলাহী র কাছে এই টাকা জমা আছে। এই টাকা দিয়েই আমার মতো মহাপাপীর শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হোক।'
এক যুদ্ধনায়কের জীবনের শেষ বয়সে লেখা চিঠি। লেখক কে জানেন? আপনার প্রিয় ফেলুদার 'বাদশাহি আংটি'র বাদশাহ......... আবদুল মুজাফফার মুহি-উদ-দিন মহম্মদ ���উরঙ্গজেব। আসমুদ্র হিমাচল কাঁপানো সেই মুঘল সম্রাট অউরঙ্গজেব......ইতিহাস যাকে অত্যাচারী, খুনি, সন্দেহপ্রবন আরও না জানি কত কি বিশেষণে ভূষিত করেছে...... সেই সম্রাট আলমগীর অউরঙ্গজেবের মুখে এই কথা?...... সত্যিই অবিশ্বাস্য। দিল্লিতে হুমায়ুনের সমাধি দেখেছি, সিকান্দ্রাবাদে আকবরের সমাধি, তাজমহলে শাহজাহানের সমাধি --- এঁদের সমাধিগুলির বিশালত্ব ও আড়ম্বর কোথাও গিয়ে তাঁদের ব্যাপ্তি ও ক্ষমতাকেই প্রতিফলিত করে। কিন্তু আলমগীর অউরঙ্গজেব? মুঘল সাম্রাজ্যের সবচাইতে ক্ষমতাশীল ও বিত্তবান শাসক.? যার মৃত্যুর পরেই ভারতবর্ষে থাবা বসানোর সাহস পায় ব্রিটিশরা সেই মানুষটির সমাধিটি কোথায়? কেমনই বা তার বিশালত্ব? ভারতবর্ষের মানচিত্রে তাকে শেষমেশ খুঁজে পেলাম একটি নাম না জানা অখ্যাত জায়গায়। ইন্টারনেটে ছবি দেখে হোঁচট খেয়েছিলাম বটে তবে পুরোপুরি তাজ্জব বনে গেলাম মহারাষ্ট্রের খুলদাবাদে সেই সমাধির সামনে দাঁড়িয়ে......না... সৌন্দর্য বা বিশালত্বে নয়........বরং তার সাধারণত্বে। কোনও এক পীর ফকিরের মত খুব সাধারণ একটি মাজার। সম্রাটের নির্দেশ মতোই অতি সাধারণ ভাবেই তাকে সমাধিস্ত করা হয়েছিল খোলা আকাশের নিচে। খুব সামান্য যতটুকু আড়ম্বর দেখলাম তাও তার মৃত্যুর অনেক পরে তৈরি। প্রশ্ন ওঠে এ কোন আলমগীর...? উত্তর থেকে দক্ষিণ...... এত রাজ্য জয়...... এত সম্পত্তি...... এত রক্তপাত...... কিসের জন্য? ইতিহাস আমাকে ভাবায়, ঐতিহাসিক স্থানে গেলে আমি রোমাঞ্চিত হই, অসাধারণ শিল্প- স্থাপত্যশৈলী দেখে মুগ্ধ হই......... কিন্তু সম্রাট অউরঙ্গজেবের সমাধি দেখার অনুভূতি এর সবার চেয়ে আলাদা। সমাধিটাই যেন ইতিহাসের খুব 'চেনা' মানুষটাকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। কোনও এক শায়রের কয়েকটি পঙক্তি মনে পড়ে যায়......
'জো চন্দ লমহো মে কট জায়ে ওহ ক্যায়া জিন্দগি,
জো আশু মে বেহ জায়ে ওহ ক্যায়া জিন্দগি,
জিন্দগি কা তো ফলসাফা কুছ ঔর হি হ্যাঁয়
জো হর কিসি কো সমঝ আয়ে ওহ ক্যায়া জিন্দগি।'
এক জিন্দগিতে একবার অন্তত দেখে আসা যায় এই বিতর্কিত সম্রাটের সমাধিটি...... 'আলমগীরের দরবার শহর'...... খুলদাবাদ তথা অউরাঙ্গাবাদে।
কি ভাবছেন? এক সমাধি দেখার জন্যে এই কলকাতা থেকে পাড়ি দেবেন সুদূর মহারাষ্ট্রের অউরাঙ্গাবাদে? খরচা, সময়, ছুটি -- কিছুতেই পোষাচ্ছে না তাই তো? তাহলে দাঁড়ান...... চমকের তো সবে শুরু......। অউরাঙ্গাবাদ বলতেই আপনার নিশ্চয়ই মনে পড়ে গেছে ফেলুদা থুড়ি কৈলাসে কেলেঙ্কারির কথা। 'কৈলাস' অর্থাৎ ইলোরা এবং ��ঙ্গে অজন্তা। অউরাঙ্গাবাদ থেকে ইলোরার দূরত্ব মাত্র ৩০ কিমি আর অজন্তা ১০০ কিমি। আমার দেড় ছটাক বুদ্ধি বা দু চিমটে মননশীলতা দিয়ে অজন্তা বা ইলোরার ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। তাই যাওয়ার আগে শ্রীনারায়ণ স্যানালের 'অপরূপা অজন্তা' বইটি পড়ার অনুরোধ রাখলাম। এটুকু বলতে পারি......... ভারতবর্ষের মানচিত্রে এর থেকে বড় স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন আর নেই। আজ থেকে প্রায় দেড় দু হাজার বছর আগে কোনও এক রাষ্ট্রকূট বংশের রাজাদের নির্দেশে বা কোনও বৌদ্ধ ধর্মগুরুর আদেশে একদঙ্গল লোক ছেনি হাতুড়ি নিয়ে টুক টুক করে পাহাড় কেটে এগুলো বানিয়ে ফেললো...... এটাকে যুক্তিসঙ্গত ভাবে কিছুতেই সাজাতে পারিনি আমি। কোথাও একটা চূড়ান্ত 'ফাঁকি' রয়েছে মশাই.........। হয় ফাঁকি আমাদের 'বোধশক্তির' (?) ......না হয় 'ফাঁকি' আমাদের জানার(?)...... না হলে 'ফাঁকি' আমাদের কল্পনাশক্তির (?)। 'কিংকর্তব্যবিমূঢ়', 'দিশোহারা', 'বাকরহিত' --- এইসব শব্দগুলির বাস্তব প্রতিরূপ যদি আপনি অনুভব করতে চান তাহলে আপনাকে একবার গিয়ে দাঁড়াতেই হবে এই দুটি 'অসম্ভব কীর্তির' সামনে।
ফিরে আসি আলমগীরের দরবারে। অজন্তা বা ইলোরার জৌলুসে যা বেশীরভাগ সময়েই ঢাকা পড়ে যায়। অউরাঙ্গাবাদ শহরের ইতিহাস অউরঙ্গজেবের থেকেও অনেক পুরনো। ভারতবর্ষের প্রায় বারশো বছর আগের ইতিহাসে দেবগিরি পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এই শহরের উল্লেখ পাওয়া যায়..... তৎকালীন নাম দেবগিরি বা বা রাজাতালাকা। পরবর্তী ইতিহাসের পাতায় এই শহর পরিচিত হয় দৌলতাবাদ নামে। উপস্থাপনায়.... ভারতবর্ষের আর এক স্বনামধন্য 'বিতর্কিত' সম্রাট-- মহম্মদ বিন তুঘলক...... হ্যাঁ... ইতিহাসের সেই পাগলা রাজা...... (অবশ্যি আমার তাকে 'পাগলা রাজা' বলাতে ঢের আপত্তি আছে)। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে নিজের রাজধানী দিল্লি থেকে এই দৌলাতাবাদে স্থানান্তরিত করেন এবং দিল্লিবাসীদের বলপূর্বক বাধ্য করেন দাক্ষিণাত্যের এই মালভূমি শহরে এসে বসবাস করতে। তবে প্রচণ্ড জলকষ্টে দু বছরের মধ্যেই আবার রাজধানী দিল্লিতে ফেরত নিয়ে যান। ইতিহাসের এই গল্প প্রায় সবারই জানা। যেটি অপেক্ষাকৃত কম জানা সেটি হল এইখানেই রয়েছে ভারতবর্ষের হয়ত একমাত্র 'অজেয়' দৌলতাবাদ কেল্লা। যাদব বংশের তৈরি এই কেল্লার রক্ষণ ব্যাবস্থা চোখ কপালে তোলার মতো। বহু দূর থেকেই আপনি দেখতে পাবেন অদ্ভুত মসৃণ এক খাড়াই ত্রিভুজাকৃতি পাহাড়ের ওপরের এই কেল্লাটি। গোটা কেল্লার কেবল একটিই মুখ্য ফটক, চারধারে পাহাড় কেটে বানানো প্রায় একশ ফুট গভীর পরিখা, চোরা অন্ধকার গলি, মারণ ��টক, পেল্লাই কামান ...... আর কত বলব। আলাউদ্দিন খিলজি সমেত কত রথী মহারথীরা এই কেল্লা বার বার আক্রমণ করে কেন জিততে পারেননি......সে আপনি কেল্লাটিতে গেলে নিজেই বুঝতে পারবেন। প্রায় ঘণ্টা আড়াই লাগবে আপনার এই গোটা কেল্লাটি ঘুরে দেখতে। খুব সম্ভবত এই কেল্লাটির 'লোভেই' তুঘলক সাহেবের ওই দিল্লি থেকে রাজধানী বদল। কেল্লাটি ছাড়াও আপনি এখানে দেখবেন চাঁদ মিনার ও চিনি মহল। বিন তুঘলক ও বাহমনি শাসকদের হাত ঘুরে এই কেল্লাটি আসে আউরঙ্গজেবের দখলে এবং তারপর কালক্রমে মারাঠা, পেশওয়া এবং শেষে নিজামের অধিনস্ত হয়। কেল্লার প্রত্যেকটি পাথর যেন এক একটি ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। আর এ ইতিহাস পরীক্ষার হলের সাল সন তারিখ চটকানো খাতা ভরানোর ইতিহাস নয়...... এ হোল মাথা ঘোরানোর ইতিহাস, গায়ে কাঁটা দেওয়ার ইতিহাস। আপনার নিজের হাঁটুজোড়া বিদ্রোহ ঘোষণা করার আগেই 'আক্রমণ' করুন এই কেল্লাটিকে। হলপ করে বলতে পারি 'কেল্লাফতে' আপনার হবেই হবে।
কেল্লাফতের পর সামান্য বিশ্রাম এবং তারপর মধ্যাহ্ন ভোজন। খোঁজ করুন 'নান খালিয়া'-র। লখনউ এর যেমন বিরয়ানী, অউরাঙ্গাবাদের তেমন নান খালিয়া। আলমগীরের দরবারের 'শাহী খানা'। বেশি কিছু বলছি না...... তবে এরকম কিছুর হাতছানি না থাকলে ওই দৌলতাবাদ কেল্লা জয় করা মুশকিল। ডান হাতের কাজটি চটপট সেরে ফেলে তৈরি হয়ে নিন দরবারের দ্বিতীয় পর্বের জন্য। প্রায় গোটা ভারতবর্ষ দখল করার পরেও অউরঙ্গজেবের রাজধানী ছিল এই অউরাঙ্গাবাদ। কারণ একটিই - দাক্ষিণাত্যে মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তারের অভিপ্রায় আর সে অর্থে অউরাঙ্গাবাদ তখন 'Gateway of Decan'। মারাঠাদের আক্রমণ থেকে অউরাঙ্গাবাদকে সুরক্ষিত করার জন্য শহরটিকে ঘিরে ফেলা হয় সুউচ্চ দেওয়ালে এবং প্রায় ৫২ টি ফটকে। যাদের মধ্যে প্রধান চারটি ফটক হল -- উতরের দিল্লি ফটক, দক্ষিণে পৈথান ফটক, পুবে জালনা ফটক আর পশ্চিমে মক্কা ফটক। গোটা শহরটি যেন এক কেল্লার রূপ দেওয়া হয়......। কয়েকটি ফটক কালক্রমে নষ্ট হয়ে গেলেও গোটা শহরে এখনও ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে অনেক গুলি ফটক......... এক ফটক দিয়ে ঢুকবেন আর অন্যটি দিয়ে বেরবেন...... সে এক মজার গোলকধাঁধা। এরকম এক আজব 'কেল্লা শহর' আমি অন্তত ভারতবর্ষে দ্বিতীয়টি দেখিনি। গাড়ি ভাড়া করে শহরে চরকি পাক দিতে দিতেই ঘুরে আসুন আরও দুটি দর্শনীয় স্থান -- প্রথমটি 'বিবি কা মকবারা' আর দ্বিতীয়টি 'অউরাঙ্গাবাদ গুহা'। এতক্ষণে হয়ত আপনার মনে পড়ে গেছে 'নকল তাজমহল' অর্থাৎ 'বিবি কা মকবারা' র কথা...... খুব সম্ভবত যা বানিয়েছিলেন অউরঙ্গজেব (বিতর্কে তাঁর পুত্র পুত্র আজম শাহ্)...... তাঁর স্ত্রী অর্থাৎ দিলরাস বানু বেগমের উদ্দেশ্যে। উর্দুতে 'বিবি' শব্দের অর্থ 'স্ত্রী' নয় বরং 'আভিজাত্য সম্পন্ন' এক মহিলা। আগ্রার তাজমহলের সাথে কোনরকম তুলনায় না গিয়ে মন খুলে উপভোগ করুন ওই অসামান্য শিল্পকর্মকে। একটা ছোট্ট তথ্য এখানে দিয়ে রাখাটা দরকার। শাহজাহানের নির্দেশে ১৬৩২ এ তাজমহল নির্মাণ করেন উস্তাদ আহমেদ লাহৌরি। প্রায় তিরিশ বছর পর অউরঙ্গজেবের নির্দেশে আহমেদ লাহৌরির পুত্র আতা-উল্লাহ তৈরি করেন এই 'বিবি কা মকবারা' --- একে বারে যাকে বলে 'পিতা-পুত্র সংবাদ'।
শেষপাতে অবশ্যই 'অস্থমহাভায় অবলোকিতেশ্বর'....... অর্থাৎ 'অউরাঙ্গাবাদ গুহা'। খুব বেশি লোক যায় না এখানে। গাড়ি ভাড়া করলে অবশ্যই আগে থেকে বলে রাখবেন এই স্পটটির কথা। 'বিবি কা মকবরা' দেখেই চলে আস্তে পারেন এখানে.... দূরত্ব মাত্র দু কিমি। গাড়ি কিছুটা তলায় রেখে পাহাড়ের ওপরে মিনিট পনেরর হাঁটাপথ। ভারতবর্ষের ইতিহাসে অন্যতম প্রাচীন শহর এই অউরাঙ্গাবাদ থুড়ি দেবগিরি। প্রথম কি দ্বিতীয় শতাব্দীর ভারতবর্ষের অন্যতম দুই প্রধান শহর পৈথান এবং উজ্জয়ীনীর সাথে ইউরোপের ব্যাবসা বাণিজ্যের 'Trade Route'-এর গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল এই অউরাঙ্গাবাদ (থুড়ি দেবগিরি বা রাজাতালাকা) এবং অজন্তা। হয়ত এই প্রেক্ষাপটেই তৎকালীন দাক্ষিণাত্যে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের তাগিদেই তৈরি হয়েছিল অজন্তা এবং এই অউরাঙ্গাবাদের গুহা...... আনুমানিক দু হাজার বছর আগে। অজন্তা গুহার মতোই এখানেও অনেকগুলি বৌদ্ধ গুহার সমাহার। শিয়াচল পর্বতশ্রেণীতে প্রায় দু কিলোমিটার বিস্তৃত এবং মোট ১২টি গুহা আর তাতে অপরূপ পাথর খোদাইয়ের শিল্পকর্ম (iconography) -- চৈত্য গৃহ, শায়িত বুদ্ধ মূর্তি., মহানয়না ও হিনয়না স্তুপা, গুহাচিত্র, গর্ভগৃহ, বোধিসত্ত্ব.....সাক্ষ্য বহন করে চলেছে শতাব্দী প্রাচীন বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার কাহিনীর। ধারে ও ভারে অজন্তা গুহার সমতুল্য না হলেও একবার অন্তত চক্ষু সার্থক করে আসুন প্প্রাচীন ভারতবর্ষের অন্যতম 'মিসিং লিঙ্ক' এই পুরনোগুহা গুলির ভেতরে গিয়ে। অজন্তা গুহার মতোই বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারকালের বিভিন্ন অধ্যায়ের প্রতিচ্ছবি পাবেন এখানে। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে এই গুহার অনেক কারুকাজই অসম্পূর্ণ...... জানিনা ইতিহাসের কোন প্রতিচ্ছবি লুকিয়ে আছে তার ভেতর।
ভ্রমণ শেষে আলমগীরের দরবারের 'পেশ-এ-খিদমৎ'.... হিমারু সিল্ক ও সেই অতিপ্রাচীন পৈথানী সিল্ক। এই অউরাঙ্গাবাদেই তৈরি হয় এই সিল্ক। হিমারু সিল্ক নাকি এসেছিল সম্রাট তুঘলকের হাত ধরেই। সিল্কের শাড়ি আর শালের ওপর পার্সিয়ান ডিজাইনের জরির অপূর্ব কারুকাজ। আর পৈথানী সিল্ক? প্রায় দুহাজার বছর আগে সাতকর্নি রাজবংশের আমলে এই সিল্ক সেই সুদূর গ্রীস আর রোমের বাজারে লালমোহন বাবুর ভাষায় যা��ে বলে 'সেলিং লাইক হট কাচৌরিস।' দিনের শেষে প্রিয়জনের হাতে এই উপহার তুলে দেওয়ার আনন্দটাই হোক আপনার আলমগীরের দরবার থেকে বিদায়ী সুরের 'দরবারী কানাড়া'। তাহলে শেষমেশ কি দাঁড়ালো? অজন্তা ও ইলোরার অপার্থিব সৌন্দর্যের কথা যদি বাদ দিলেও...... এক অনুতপ্ত পিতা ও দেশের অন্যতম সেরা সম্রাটের নিস্তব্ধ সমাধি, যুদ্ধের পটভূমিকায় বারুদের গন্ধ মেশানো এক দুর্ভেদ্য কেল্লা, এক 'অত্যাচারী' সম্রাটের প্রেমকাহিনীর প্রতিচ্ছবি, দু হাজার বছরের পুরনো বৌদ্ধগুহা এবং একটি ঐতিহাসিক 'কেল্লা শহর' -- খরচা, সময়, ছুটি সব ছাপিয়েও সারাজীবনের স্মৃতির হাতছানি আপনার সামনে।
আপনার সুবিধার্থে একটা ট্যুর প্ল্যান করে দিলাম। প্রথমে আপনাকে যেতে হবে ভুসওয়াল। হাওড়া থেকে ট্রেন আছে প্রচুর -- গীতাঞ্জলী এক্সপ্রেস, জ্বানেশ্বরী এক্সপ্রেস বা আজাদ হিন্দ এক্সপ্রেস। তবে সবথেকে ভালো বোধহয় হাওড়া- মুম্বাই দুরন্ত এক্সপ্রেস...... ভোরবেলায় পৌঁছে দেবে ভুসওয়াল। ব্রেকফাস্ট সেরে বাস বা গাড়িতে সোজা চলে আসুন অউরাঙ্গাবাদ....সময় নেবে ঘণ্টা চারেকের মত। স্নান খাওয়া সেরে অল্প বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন শহর দেখতে। দ্বিতীয় দিন একটা গাড়ি ভাড়া করে সারাদিন ধরে দেখুন আউরঙ্গজেবের সমাধি, দৌলাতাবাদ কেল্লা, বিবি কা মকবরা, অউরাঙ্গাবাদ গুহা। তৃতীয় দিনটা থাকুক ইলোরার জন্যে। আর চতুর্থ দিন সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে হোটেল চেক আউট করে বেরিয়ে পড়ুন অজন্তার উদ্দেশ্যে। সারাদিন অজন্তা গুহাতে কাটিয়ে ভুসওয়াল থেকে রাতের হাওড়া- মুম্বাই দুরন্ত এক্সপ্রেস ধরে ফিরে আসুন। ট্রেনের টিকিট কাটার আগে দিন গুলো একটু দেখে নেবেন কারণ হাওড়া- মুম্বাই দুরন্ত এক্সপ্রেস সপ্তাহে চারদিন চলে। আর বিমানে যেতে চাইলে কাছাকাছি এয়ারপোর্ট মুম্বাই... সেখান থেকে গাড়িতে বা বাসে অউরাঙ্গাবাদ। অউরাঙ্গাবাদে প্রচুর হোটেল......অনলাইনে বুকিং পেয়ে যাবেন। তবে অউরাঙ্গাবাদে না থেকে অভিরুচি অনুযায়ী আপনি ইলোরাতেও থাকতে পারেন -- হোটেল কৈলাস -- একেবারে ইলোরা গুহার সামনে। 'কৈলাসে কেলেঙ্কারি' তে ফেলুদাও কিন্তু এখানেই ছিলেন।
0 notes
Text
মায়ার খেলা
রোজ আয়ালমার। বাড়ি ছিল সেই সুদূর ইংল্যান্ডের সাউথ ওয়েলসে। বাবাকে সে হারিয়েছিল খুব ছোটবেলাতেই। রোজে��� তখন বয়স ১৭ - এক বুদ্ধিদীপ্ত সতেজ তরুণী। তখনই আলাপ হয় ওয়াল্টারের সাথে। ওয়াল্টারের বয়স তখন একুশ। সতেরো-একুশের যুগলবন্দীতে বয়ে যা��� অনেককিছু। ওয়েলস পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে তাঁদের কতই না গল্প। সে গল্প যে তখন আর গল্প নেই...... সময় তখন রূপকথার জাল বুনছে। কে জানে সেখানে কে কার প্রেমে পড়েছিল? সেখানেও কি প্রতিযোগিতা চলে নাকি? আঁকাবাঁকা পথে হাঁটতে হাঁটতেই হয়ত এক সহজ সরল ভবিষ্যতের কল্পনা করেছিল তাঁরা।
কিন্তু সবার অগোচরেই এক অদৃশ্য তৃতীয় পক্ষও যে তাঁদের পিছু নিয়েছিল। অসম্ভব জেদি আর একগুঁয়ে সেই তৃতীয় পক্ষ তখন আড়াল থেকেই মনেপ্রাণে রোজ কে নিজের করে পেতে চাইত। ওয়াল্টার তখন উঠতি কবি কিন্তু সেই তৃতীয় পক্ষ তখন অপর্যাপ্ত ক্ষমতাশালী। নিজের ক্ষমতাবলে রোজকে সরিয়ে নেয় ওয়াল্টারের থেকে। সুদূর ইংল্যান্ড থেকে রোজকে পাঠানো হয় আমাদের এই কলকাতায়। সালটা তখন ১৭৯৮। কলকাতার হাইকোর্টের জজ স্যর হেনরি রাসেলের বাড়িতে স্থান হয় রোজের। কিন্তু তাতেও যে আশ মেটে না সেই তৃতীয় পক্ষের - মাথা চাড়া দেয় রোজকে পাওয়ার অদম্য ইচ্ছা। দু বছরের মধ্যে সে সফলও হয় সেই অভিসন্ধিতে। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে ১৮০০ সালে কলেরা রোগে মারা যায় রোজ.........আর চিরকালের মত তাকে আত্মসাৎ করে সেই তৃতীয় পক্ষ।
কিন্তু আত্মসাৎ এর গল্পই কি সবসময় শেষ কথা বলে? কোনও এক 'মায়ার খেলাতেই' পার্ক স্ট্রীট গোরস্থানে শ্যাওলা সবুজ পথের ধারে চির শায়িত রোজের কবরে আজও যে লেখা সেই উঠতি কবি ওয়াল্টারের কবিতা --
Ah what avails the sceptred race,
Ah what the form divine!
What every virtue, every grace!
Rose Aylmer, all were thine.
Rose Aylmer, whom these wakeful eyes
May weep, but never see,
A night of memories and of sighs
I consecrate to thee.
0 notes
Text
আনন্দবসন্তসমাগমে
'অসীম সে চাহে সীমার নিবিড় সঙ্গ,
সীমা চায় হতে অসীমের মাঝে হারা।'
এ কি এক 'স্বর্গীয় প্রহসন'? নাকি 'অরসিকের স্বর্গপ্রাপ্তি?' ---- সেই 'প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে' তিনি আসবেন আমার বাড়ি। হ্যাঁ মশাই... ঠিকই শুনেছেন। ��িনি... মানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই রবীন্দ্রনাথ -- যার সাথে প্রথম পরিচয় সেই কিশলয় বইয়ের সূচীপত্রে আর যাকে এখন রোজ শুনতে পাই ট্রাফিক সিগনালে। বিশ্বকবি নন...... আসছেন মানে সেই ১৫৭ বছর ২ মাস ২৩ দিন বয়সের প্রগতিশীল মানুষটা। কি বললেন- আমার বাড়ি কোথায়? সে সন্ধান আমি আপনাকে দিচ্ছি না। আমি বললেই আপনি দলবল সমেত হাজির হয়ে আমাদের আড্ডাটা পণ্ড করবেন আর কি। তাই আপনি চুপটি করে বসে থাকুন আর আমি একটু ভাবি।
'মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো
দোলে মন দোলে অকারণ হরষে'।
কি ভাবছি? ভাবনা তো একটাই। মানুষটা তো আসছেন। কি খেতে দেওয়া যায় ওনাকে? মানে ১৫৭ বছর বয়স--- কি কি বিধি নিষেধ আছে...... সুগার, প্রেশার, অম্লশূল...... কিছুই তো জানি না। চর্ব্য না চোষ্য? নাকি লেহ্য বা পেয়? ঝাড়া পনেরো মিনিট ভেবে...... মধ্যে দুবার 'সুইগি' আর একবার 'জোমাটো' খুলে দেখে...... শেষে 'ধুত্তরি' বলে একটা কথাই মাথায় এলো -- 'কি লাভ হল পড়াশুনো শিখে? কোনকিছুই যে কাজে দিচ্ছে না'......... 'ভাবনা যে এখন আমার কাছে সত্যিই... যাতনাময়'।
আর বলিহারি ভদ্রলোকের...... একটু সময় দেবেন তো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে কথা। আসল ঘটনার সূত্রপাত গতকাল রাত্রে...... ঐ সন্ধ্যেবেলায়। চায়ের ভাঁড়ে একরাশ তর্কাতর্কী চলছিল পাড়ার মোড়ের দোকানে। বিষয় ছিল - রবীন্দ্রনাথের গানের রিমেক এবং তার যৌক্তিকতা। দুই পক্ষের তর্কের ঝড়ে আমি ছিলাম একমাত্র তৃতীয় পক্ষ। মানে দোনোমনায় ভোগা বাঙ্গালীর প্রতিরূপ...... আর কি? শেষমেশ বাড়ি ফিরে রবীন্দ্রনাথের গান নিয়েই ছিলাম অনেকক্ষণ। ওনার ছোটগল্প বা কবিতা খুব বেশী পড়া নেই আমার। গান আমি গাইতে পারি না -- সুর--তাল--লয়ের জ্ঞানও তথৈবচ। তবে তা নিয়ে আমার কোনও লজ্জা নেই। সাহস জুগিয়েছেন সেই রবীন্দ্রনাথ --
'নাহয় তোমার যা হয়েছে তাই হল।
আরো কিছু নাই হল, নাই হল, নাই হল।'
আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গীতিকার। আমি ওনার গানের যত না শ্রোতা তাঁর থেকে অনেক বেশী 'পাঠক'। হ্যাঁ... আমি ওনার গানের 'কথা' পড়ি -- একবার নয় -- বারবার -- মনের সমস্ত অনুভূতির সাথে কেমন যেন মিলে যায় কথা গুলো। এই রকম অনেকক্ষণ 'গান পড়ে' যখন শুতে গেলাম... তখন প্রায় রাত ১ টা ১০।
'যে আমারে চিনতে পারে
সেই চেনাতেই চিনি তারে,
একই আলো চেনার পথে
তার প্রাণে আর আমার প্রাণে।'
এমনিতে আমি ভোরবেলার মানুষ নই। তবে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে আজ অনেক ভোরেই ঘুম ভাঙ্গল। সদর দরজা খুলতে গিয়েই পাই চিঠিটা...... কিছু একটা দিয়ে দরজায় আটকানো ছিল। চিঠি না অবিশ্যি...... একটা চিরকুট ---
লেখা ছিল......
বন্ধু,
'দিনের পথিক মনে রেখো,
আমি চলেছিলেম রাতে
সন্ধ্যাপ্রদীপ নিয়ে হাতে ।
যখন আমায় ও-পার থেকে
গেল ডেকে.........
বাকি কথা দ্বিপ্রহরে...... তোমারি গৃহে।'
তলায় সেই সই আর হাতের লেখা (এবং কাটাকুটি) দেখে আমি ১০০% নিশ্চিত...... যে তিনি আসছেন।
মন আমার তখন 'বাঁধন-ছেড়া প্রাণ'। ধুকপুকানির বদলে তখন 'রুনুরুনু রুনুরুনু নূপুরধ্বনি'। আর সঙ্গে এক আকাশ প্প্রশ্ন - হবে তো সেই 'প্রাণ জুড়ানো সুখের দুখের কথা'?' 'মেলে দিতে পারব তো গানের সুরের সেই ডানাটি?' কতক্ষণ এই 'মোহমেঘে' ছিলাম জানি না। তবে সম্বিৎ ফিরল একটা লাখ টাকার প্রশ্নে। 'থরহর কম্পিত' করা সেই প্রশ্নটি ছিল - 'কি খাওয়াবো ওনাকে? ---- 'ঝুনি-রাইয়ের ঝালকাসুন্দি?' নাকি 'আমসত্ত্ব দিয়ে উচ্ছে সিদ্ধ?' নাকি 'পিড়িং শাকের চচ্চড়ি?' নাকি 'জিরাফের মুড়িঘণ্ট?' নাকি 'সরষে বাটা দিয়ে তিমি মাছ ভাজা?'---- নাহ মাথাটা কিরকম গুবলেট হয়ে যাচ্ছে। 'দ্বিপ্রহর' মানে তো আমার হাতে কেবল কয়েকটি ঘণ্টা! ......যার মধ্যেই আমাকে তৈরি করে ফেলতে হবে 'মেনু কার্ড', আর তারপর বাজার আর শেষে রান্না। জয়গুরু থুড়ি 'কবিগুরু' বলে লেগে পড়লাম কাজে ---
'নিশিদিন ভরসা রাখিস, ওরে মন, হবেই হবে।
যদি পণ করে থাকিস সে পণ তোমার রবেই রবে।
ওরে মন, হবেই হবে।'
উনি খেতেন টেবিলে আর মার্বেলের বাসন পত্রে সাজানো থাকত খাবার। মার্বেল আর আমি কোথায় পাবো তাই প্রথমেই বার করলাম অনেকদিন আগে কেনা বোন চায়নার ডিনার সেটটাকে। খাওয়ার সময় হাতের থেকে চা��চ বা কাঁটা চামচের ব্যবহারই উনি করতেন বেশী। আমার বাড়িতে চামচ থাকলেও -- কাঁটা চামচ গুলো নিতান্তই পুরনো - সেই 'তানপুরাটার তারগুলির' মত। তাই প্রথমেই একটা কাঁটা চামচের সেট কিনতে হবে।
চামচ বিভ্রাটের পরবর্তী অংশ 'মেন্যু'। যা ঠিক করা বেশ দুঃসাধ্য ব্যাপার - বিশেষ করে ওনার মত মানুষের ক্ষেত্রে যার জীবন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন খাতে বয়েছে এবং সেই সঙ্গে পাল্টেছে তাঁর খাদ্যাভ্যাসও। দ্বারকানাথ তথা দেবেন্দ্রানাথ ঠাকুরের এক অতি সচ্ছল ধনী পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম রবীন্দ্রনাথ --- ��েবেন্দ্রানাথ ঠাকুরের চোদ্দতম সন্তান। পরিবার 'সচ্ছল' হলেও বাবা মায়ের খুব বেশী 'সান্নিধ্য' মনেহয় উনি পাননি। বাড়ির চাকর বাকরদের হাতেই ছিল ওনার খাবারের দায়িত্ব - তাতে লুচি, কলা, সন্দেশ, দুধ থাকলেও কতটা আন্তরিকতা ছিল -- সে প্রশ্ন থেকেই যায়। কি বলতে চেয়েছিল আট বছরের বালক রবি --- 'পিপিড়া কান্দিয়া যায় পাতে'? কেন? জিগ্যেস করতে হবে ওনাকে।
'আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতে কদলি দলি,
সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে।
হাপুস হুপুস শব্দও, চারিদিক নিঃশব্দ,
পিপিড়া কান্দিয়া যায় পাতে।'
দ্বারকানাথ তথা দেবেন্দ্রানাথ ঠাকুরের সাথে তৎকালীন ব্রিটিশদের সম্পর্কের খাতিরে ঠাকুরবাড়ির রান্নাঘরে বাঙ্গালী রান্নার সাথে চল ছিল বিলিতি রান্নার। পরবর্তী কালে বিশ্বকবি নিজেও ঘুরেছেন পৃথিবীর অনেক দেশে -- চেখেছেন সেখানকার খাবার। যেগুলো ভালো লাগত সেই পদগুলির রেসিপি উনি সঙ্গে করে আনতেন এবং ঠাকুরবাড়ির রসুইঘরে সেই সমস্ত পদ তৈরি করাতেন। সবমিলিয়ে বলা যেতে পারে বিলিতি আর বাঙ্গালী রান্নার সংমিশ্রণে (ফিউশন পদ) অনেক নতুন বাঙ্গালী রান্নার আঁতুড়ঘর ছিল ঐ ঠাকুরবাড়ির রান্নাঘর -- সে 'এক্সপেরিমেন্টে' নিরামিষ থেকে আমিষ বাদ ছিল না কোনও পদই। তবে এই মানুষটিই নাকি জীবনের কোনও এক সময়ে স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্যে কাঁচা সবজি লেবুর রস দিয়ে খেয়েছিলেন বেশ কয়েকদিন। মধ্যে এ ধারণাও হয় যে শরীর আর মনের জন্যে 'নিম পাতার রস' আর 'ক্যাস্টর অয়েলে ভাজা পরোটাই' নাকি সবচাইতে উপকারী। বুঝুন কাণ্ড!
যাই হোক। ফিরি আমার বর্তমান জীবনের 'মেন্যুকার্ড' অধ্যায়ে। 'প্রথমে কি দেওয়া যায় ওনাকে?' আমপোড়া সরবত নাকি কফি-পাকোরা? নাহ...... ওসব লোক ঠকানো আইটেম। আমি নিজেই বিয়েবাড়িতে খাইনে ওগুলো...। ঘড়ি বলছে ছটা পাঁচ। একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু আজ তো আমার 'ভোরের বেলা ফুল তোলার দিন' ---- ঘুমোলে তো চলবে না। বিদ্যুৎ গতিতে মনে পড়ল চা এর কথা। কবিগুরুর চা ছিল স্পেশাল গোছের...... অবশ্যি সেটা চা নাকি 'গরম জল' সে বিতর্কে আমি নেই। ফুটন্ত গরম জলে নামমাত্র চা পাতা দিয়ে ভিজিয়ে আর তাতে দুধ আর দু চামচ চিনি। ঠিক করলাম এইটেই হবে আমার প্রথম আইটেম --- 'চা'য়নিকা। নিজের জন্যে এক পেয়ালা বানিয়ে 'পাগল আমার মন... জেগে ওঠে'।
এই বার মেইন কোর্স। বাঙ্গালী?- কন্টিনেন্টাল? - নাকি চাইনিজ? কেন জানিনা...... তবে ভাবতেই কি রকম একটা লাগলো যে উনি আমার বাড়িতে বসে চাউমিন আর চিলি চিকেন খাচ্ছেন। এটা জাস্ট নেওয়া যাচ্ছে না...... তাই চাইনিজ বাদ। সমস্যা হল বাকি দুটিকে নিয়ে। দিনেরবেলা কবি খেতেন বাঙ্গালী রান্না আর ডিনার হত কন্টিনেন্টাল। তাই ঠিক করলাম বাঙ্গালী আর কন্টিনেন্টাল দু রকম পদ দিয়েই রচিব 'মম ফাল্গুনী' থুড়ি মেন্যু কার্ড। অতিসাবধানে যাকে ভাগ করলাম তিনটি ভাগে - 'নিরামিষ', 'আমিষ' আর শেষের কবিতা 'মিষ্টান্ন'।
'তোমায় কিছু দেব ব'লে চায় যে আমার মন,
নাই-বা তোমার থাকল প্রয়োজন।'
সাদা ভাত -ই থাকুক আর ওনার ছোটবেলার স্মৃতিকে উস্কে দিতে সঙ্গে থাকুক সুক্তো আর সঙ্গে বড়িভাজা। তারপর চালতা দিয়ে মুগের ডাল আর সঙ্গে ওনার অতিপ্রিয় পোস্তচচ্চড়ি। এর পর থাকুক 'নিরামিষ ডিমের ডালনা'। এই পদটির সাথে ডিমের কোনও যোগ নেই -- আমার আপনার কাছে এটি 'আলুর রসা' নামেই পরিচিত। পূর্ণিমা দেবীর বই থেকে এটিকে এইমাত্র উদ্ধার করলাম -- এও এক আবিষ্কার বটে। ঝটপট রেসিপিটা টুকে রাখলাম -- চালান করব আমার রান্নাঘরে...... কিছুটা কবিগুরুর আদলেই। এর সাথে রাখব ছানার ডালনা...... এটি অবশ্য আমার ফেবারিট। ছানার প্রসঙ্গে মনে পড়ল পনীরের কথা। এই আজব বস্তুটি কবিগুরু খেয়েছেন বলে তো মনে হয় না। ইচ্ছে করছে কবিকে পনীর খাওয়াতে...... মানুষের বোধবুদ্ধির অবক্ষয়য়ের জলজ্যান্ত উদাহরণ বোধকরি এই পনীর নামক বস্তুটি। তবে ভয় হচ্ছে... এইটি খেয়ে কবি না গেয়ে বসেন......
'কোনো আয়োজন নাই
একেবারে, সুর বাঁধা হয় নি যে
বীণার তারে—'
রবীন্দ্রনাথের 'আমিষ' অধ্যায়টি যেমন রাজকীয় তেমনিই রসনাসিক্ত। ভাবতে অবাক লাগে যে যে মানুষটির কোনোএক সময়ে চিকেন, মাটন, ভেড়ার বিভিন্ন প্রকারের কাবাব ছিল অতি প্রিয়...... সেই মানুষটাই শান্তিনিকেতনের আশ্রমে ছাত্রদের সাথে অমায়িক ভাবে হয়ে উঠেছিলেন নিরামিষাশী। আমিষ অধ্যায়ের ওনার সবচাইতে ইন্টারেস্টিং চ্যাপ্টার বোধহয় 'খামখেয়ালী সভা'। কবিগুরু আর এবং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রস্তাবে এই সভা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৯৭ সালে। আর এই সভায় থুড়ি আড্ডায় আসতেন বাংলার ইতিহাসের প্রবাদপ্রতিম 'সিরিয়াস' মানুষ জনেরা - করুণাচন্দ্র সেন, অতুলপ্রসাদ সেন, চিত্তরঞ্জন দাস, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, জ্ঞানেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ।
অতুলপ্রসাদ সেনের কথায় - "এ সভার কার্যপ্রণালী ছিল খামখেয়ালী, নিয়মের কোনো বাঁধাবাঁধি ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল– হাস্যরসের উদ্দীপনা করা, সাহিত্যিকে আনন্দে সরস করা, নানাবিধ সংগীতের দ্বারা সভ্যদের চিত্ত আকৃষ্ট করা এবং সভান্তে জঠরের সম্যক তুষ্টি সাধন করা।"
আর এই 'জঠরের সম্যক তুষ্টি সাধন' ব্যাপারটা বিশেষ করে মেন্যু গুলো জানার পরে এই সাতসকালে আমার নোলা দিয়ে জল গড়াচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ তখন শিল্পী...... নাকি আতিথেয়তায় টইটম্বুর গৃহকর্তা...... নাকি বৈচিত্র্যপূর্ণ রন্ধন-বৈজ্ঞানিক...... সে ঠাহর করা আমার পরিসীমার বাইরে। স্ত্রী মৃণালিনী দেবী ছিলেন দোসর। কর্তা-গিন্নী মিলে অতিথিদের খাওয়াতেন নতুন নতুন ফিউশন পদ-- কচ্ছপের স্টু, খরগোশের পাই, টার্কির রোস্ট, মাগুর মাছের হিঙ্গি, আনারস সহযোগে রোস্টেড মাটন, চিংড়ি মাছের চিনে কাবাব। ......একটি দুর্বিনীত মশার কামড়ে সম্বিত ফিরল আমার। মার্বেলের প্লেটে সাজানো ঐ খাবার গুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে 'চা'য়নিকা তে এক চুমুক দিয়েই শেষ অবধি 'রাবিন্দ্রিক' রসনা নিবারিত করিলাম। নাহ...... দশটা-পাঁচটা (থুড়ি নটা-ছটা) চাকুরীজীবী বাঙ্গালীর রান্নাঘরে এইসব রান্নার কল্পনা করাও মহাপাপ। অগত্যা...... আমিষ পর্বে আমি রাখলাম কবিগুরুর কয়েকটি প্রিয় পদ -- মাছের পোলাও, চাপিলা মাছ ভাজা, কাঁচা আম দিয়ে শোলমাছ, কাঁচা ইলিশের ঝোল আর হিং ও জিরেভাজা দিয়ে ঝাল ছাড়া কচি পাঁঠার মাংসের ঝোল। সব রান্নায় ঝালের বহরটা কম রাখতেই হবে -- কারণ কবিগুরু ঝাল খেতে পারতেন না। আর অধুনা বাংলায় রান্নায় চিনির বহুল প্রচলন যে ওই ঠাকুর বাড়ির
অন্দরমহল থেকেই।
সেই সুবাদেই কি কবি লিখেছিলেন.........
'আমি চিনি গো চিনি তোমারে......?' সাহস করে জিগ্যেস করেই ফেলব একবার।
এই বারে 'শেষের কবিতা' অর্থাৎ মিষ্টান্ন...... খুব সম্বভত গুরুদেবের প্রিয়তম খাবার (এবং আমারও)। কমলালেবুর ফুল থেকে তৈরি মধু -- টোস্টের উপর প্রায় কোয়ার্টার ইঞ্চি পুরু করে তিনি খেতেন। আর এই মিষ্টান্ন অধ্যায়ে মনে হয় আমি সব থেকে বেশী ছড়াব। কোথায় পাবো বলুন তো মানকচুর জিলিপি বা দইয়ের মালপো বা পটলের মোরব্বা কিমবা পরিবন্ধু গজা? আরও শুনবেন -- কাঁচা মহুয়ার ক্ষীর, কৎবেলের জেলি বরফি বা আখরোটের ভাপা পুডিং। নাহ...... নিজের মানসিক যন্ত্রণা আর বাড়িয়ে কাজ নেই। উফফফ...... মৃণালিনী দেবীর রান্না ঘর ছিল না ��্যাবরেটরি? আমি করজোড়ে গুরুদেবের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেব...... এ কল্পনাতীত ব্যাপার স্যাপার...... আমার সাধ্যের বাইরে। কিন্তু মিষ্টি মুখ না করিয়ে ওনাকে বিদায় দিলে আমার নরকেও স্থান হবে না। পায়েসটা বাড়িতেই হোক...... আর বাকি মিষ্টান্ন? মিনিট পাঁচেক ভাবলাম -- প্রথমে শ্যামবাজার, তারপর হেদুয়া, তারপর বালিগঞ্জ, তারপর কাঁকুড়গাছি। ঠাকুরবাড়ির সমতুল্য হয়ত হবে না কিন্তু এই কলকাতার বাছাই করা কিছু মিষ্টি খাওয়াতে চাই কবিকে।
"So in the streets of Calcutta I sometimes imagine myself a foreigner, and only then do I discover how much is to be seen..."
যে কলকাতার রাস্তায় কবির নিজেকে 'বিদেশী' মনে হত আজ সেই কলকাতারও যে প্রতিদান দেওয়ার সময়...... হয়ত তার সবচাইতে প্রিয় সন্তানকে। আর 'মিষ্টিমুখের প্রতিদান', কলকাতা ছাড়া আর কেই বা দিতে পারে !
---- এবার বেরোতে হবে। আর বাকি কাজ বাড়ি বসে হবে না। ঘড়িতে সাতটা পঁয়ত্রিশ।
'এখন আর দেরি নয়, ধর্ গো তোরা হাতে হাতে ধর্ গো।
আজ আপন পথে ফিরতে হবে সামনে মিলন-স্বর্গ।'
=====
পুনশ্চ ঃ আপনাদের মধ্যে যারা ভেবেছেন যে এই বারে আমার 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ' হবে এবং ঘুম থেকে উঠে আমি ফ্যালফেলিয়ে চেয়ে থাকব সিলিঙের দিকে ...... তাদের জন্যই এই অংশটি লেখা। জেনে রাখুন -- আজ দিনটা প্রকৃত অর্থেই 'রবিবার' -- সামনের ক্যালেন্ডারে জ্বলজ্বল করছে লাল রঙের তারিখটা। আর উপরের সব কিছুই স্বপ্নাতিত হলেও.........ঘোর বাস্তব। এই মাত্র একটা চিমটি কেটেও দেখলাম নিজেকে --- দিব্বি লাগলো। আরও জানিয়ে রাখি...... আমার আয়োজন সম্পূর্ণ। বাজার করে রান্নাঘরে চালান করেছি প্রায় ঘণ্টা দেড়েক হল। কাঁটা চামচের সেটও হাজির। ঘড়িতে এখন ১২ টা ১০। তবে হ্যাঁ...... চাপিলা মাছ পাইনি। বদলে এনেছি মৌরলা মাছ। আর তারপর ট্যাক্সি করে কলকাতার হাফ চক্কর মেরে মিষ্টি পর্ব সম্পন্ন করেছি। গিরীশ-নকুরের 'মনোহরা' আর 'চন্দ্রপুলি', বলরাম মল্লিকের 'আবার খাবো সন্দেশ' আর 'ভাজা রাঙা আলুর পিঠে', দেশপ্রিয়র 'মধুপর্ক', বিকানির ভুজিয়াআলার 'রাবড়ি মালপোয়া' আর আমার স্কুল পাড়ার একটি অখ্যাত দোকানের 'চিনি পাতা সাদা দই' আর 'মাখা সন্দেশ'। সদ্য স্নান সেরে এসে বসেছি। আর বাড়ি এখন রজনীগন্ধা আর ইলিশ মাছে 'মধু গন্ধে ভরা'। টেবিলের ওপর আগ্রা থেকে কেনা একটা তাজমহলের তলায় কয়েকটা ফুলস্কেপ কাগজ আর পাশে একটা ফাউন্টেন পেন। দখিনা বাতাসে (নাকি অন্য কোনও কারণে) জানলার পর্দা আর ওই কাগজগুলো হালকা উড়ে নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছে এই 'আনন্দবসন্তসমাগমে'।
কলিং বেলের শব্দ।
আমি চললাম। আপনি থাকুন আপনার সন্দেহবাতিক মন নিয়ে।
'বুঝি গো রাত পোহালো,
বুঝি ওই রবির আলো
আভাসে দেখা দিল গগন-পারে–
সমুখে ওই হেরি পথ,
তোমার কি রথ পৌঁছবে না মোর-দুয়ারে।'
0 notes
Text
A 'Hamlet' of Colonial Cousins
মাসকাবারি পত্রিকায় এপ্রিল ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত
সেন্ট্রাল আভেনিউতে একটা কাজ ছিল। বাড়ি থেকে বেরনোর সময় ব্যাগে ক্যামেরাটা ঢোকাতে ভুলিনি...... সৌজন্যে শ্রী অঞ্জন দত্ত। দিন কতক আগেও একবার চেষ্টা করেছিলাম। রাস্তার লোকজনকে জিগ্যেস করে বুঝেছিলাম যে তারাও ঐ জায়গাটি সম্বন্ধে আমার মতোই 'জ্ঞানের বাহার জ্ঞানদারঞ্জন'। সেদিন তাড়া ছিল বলে ফিরতি পথে হাঁটা লাগিয়েছিলাম। কিন্তু আজ...... দিনটা অন্য...... প্ল্যানটা অন্য..... আর তাই ফলফলটাও অন্য।
অঞ্জনবাবুর গানের খুব একটা বিশেষ ভক্ত না হলেও ওনার সেই 'ম্যারী এ্যান' গানটা কোথাও একটা ছুঁয়ে গেছিলো...... বিশেষত কতকগুলো শব্দ --- 'কালো সাহেব', 'রয়ে গেলে তোমরা আকড়ে রিপন স্ট্রিট', 'ছোট্ট বেলার প্রেম আমার কালো মেম'। কালো সাহেব? কালো মেম? রিপন স্ট্রীট? বলতে দ্বিধা নেই...কিচ্ছুটি মাথায় ঢোকেনি। তারপর ওনার সেই 'বড়া দিন' সিনেমাটা। সিনেমাটি দেখিনি...... পেপারে রিভিউ পড়েছিলাম......। আর সেইখান থেকেই পাই আপাত চেনা অথচ অজানা একটি শব্দ -- অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। বছর কুড়ি- বাইশ বাদে শব্দটি আবার মাথা চাড়া দেয় কিছু পুরনো বই পত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে।
কেমব্রিজ ডিকশনারি মতে 'অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান' অর্থাৎ 'mixed British and Indian parentage' এবং যার সূত্রপাত সেই জোব চারনকের সময়কাল থেকে। এক্ষেত্রে জানিয়ে রাখা ভালো যে জোব সাহেব বিয়ে করেছিলেন এক ভারতীয় মহিলাকে এবং তাদের তিনটি মেয়ে...... এরাই হয়ত কলকাতার প্রথম হাইব্রিড ব্রিটিশ। আর শুধু ব্রিটিশ কেন, এই বিবাহ বা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের মিশেলে...... ইউরোপের বিভিন্ন সম্প্রদায় (ফরাসী, পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, আর্মেনিয়ান, জার্মান...) এর সাথে ভারতের হিন্দু, মুসলিম গোষ্ঠীর মহিলাদের সন্তান সন্ততি... সব মিলিয়ে এককথায় 'ইউরেশিয়ান গোষ্ঠী', যার জনসংখ্যা তৎকালীন কলকাতার জনসংখ্যা অপেক্ষা নেহাতই ফেলনা ছিল না। কিন্তু ঐ যে আমাদের so called 'সমাজ ব্যবস্থা' এবং তাদের 'হাড় হাভাতে জাত্যাভিমান'...... কি ব্রিটিশ...... কি ভারত...... সবই সমান। মোদ্দা কথাটি ছিল যে এই সন্তানরা 'হাইব্রিড' অর্থাৎ তথাকথিত 'বিশুদ্ধ' নন...... তাই তৈরি হল তৃতীয় একটি গোষ্ঠীর -- অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। এদের দেশ কোথায়? জানা নেই। ব্রিটেন এদের নিতে অস্বীকার করে আর ভারতে এঁরা সমাজবহির্ভূত গোষ্ঠী। কল্পনা করা সম্ভব সেই জাত সম্বলিত তির্যক মন্তব্য গুলিকে -- 'বর্ণ সংকর' বা 'ফিরাঙ্গি' বা 'ইউরোপের এস্কিমো'। এককথায় 'বাপে খেদানো...... মায়ে তাড়ানো'। অন্তরায় তখন গায়ের রং, কিম্বা বাবা - মা এর পরিচয়......। 'অস্থায়িত্ব (Instability)' এবং 'অনিরাপত্তা (Insecurity)' এই দুই অশুভ শক্তির সঙ্গে ক্রমবর্ধমান দুশো বছরের লড়াই -- তখন এদের বেঁচে থাকার তাগিদের সঙ্গে সমার্থক। কি বলা যায় একে...... 'মেন্ডেলের সূত্রের করুণ পরিণতি' নাকি অঞ্জনবাবুর গানের লাইন ধরে 'যিশুর চোখে জল'? তবে এখানে বাদ সাধে 'কলকাতা'...... এবং সেই জন্যেই এই সরাইখানা-শহরটা ভারতের অন্যান্য শহরগুলির থেকে আলাদা। মনে হাজারো 'কিন্তু' কে রেখেই হয়ত এই সরাইখানার কিছু কুঠুরিতে স্থান হয়েছিল এই গোষ্ঠীর মানুষজনদের। তেমনি এক 'কুঠুরির' নাম হল 'বো ব্যারাক'...... আমার আজকের গন্তব্যস্থল আর সঙ্গে (কাল্পনিক) মেরি এ্যান।
মেরি এ্যান থাকতেন রিপন স্ট্রীটে আর আমি থুড়ি 'আমরা' চলেছি 'বো (Bow) স্ট্রীট' (.....বউ স্ট্রীট বলছি না) অর্থাৎ 'Bow Bazar Police Station এর পেছনে। আজও লোকজনকে জিগ্যেস করে প্রথমে বিশেষ লাভ হয়নি... সার সার মোটর পার্টসের দোকান, ল্যাপটপ সারাইয়ের দোকান...... ভুল পথে ঢুকলাম Metacalfe স্ট্রীট। অবশ্যি তাতে আমার ক্ষতির থেকে লাভ হল ঢের বেশী। তবে সে গল্প অন্যদিন। বেশ কিছুটা ঘোরাঘুরির পরে রাস্তার এক মোড়ে আর এক 'মেরি এ্যান' এর দেখা পেলাম। পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দিলেন 'Go straight and then turn left'. উরিব্বাস...... কি দাপট। আর হবে নাই বা কেন। কলকাতার বেড়ে ওঠায় এই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পুরুষদের কৃতিত্ব একটুও ছোট না করেই বলছি...... কলকাতার আপাত 'সাবালক' হওয়ার পেছনে' অ্যাংলো ইন্ডিয়ান রমণীদের অবদান অনেক বেশি (অন্তত আমার তাই মত)। কলকাতার ইতিহাসে এই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান রমণীরাই প্রথম 'হেঁসেল' ছেড়ে ঘরের বাইরে পা বাড়িয়ে ছিলেন। বলা যেতে পারে কলকাতার প্রথম Working Woman। স্কুলের শিক্ষিকা, এয়ার হোস্টেস, রিসেপসনিস্ট, সেক্রেটারি, ক্লার্ক, টাইপিস্ট, হাসপাতালের সিস্টার/মেট্রন আরও কত কি। 'বাড়ির গিন্নী থেকে 'রোজগেরে গিন্নী' --- যা তথাকথিত (বা হয়ত এখনও) পুরুষ শাসিত বাংলায় ঘোরতর নিষিদ্ধ। সেই বাংলার ফুল্লরা, অভাগী বা বেহুলাদের...... শিক্ষার প্রয়োজন, রোজগারের তাগিদ এবং সর্বোপরি স্বাধীনভাবে বাঁচার অনুপ্রেরণা হয়ত জুটিয়ে ছিলেন তৎকালীন এই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান রমণীরাই। মনে পরে গেল সত্যজিৎ রায়ের 'মহানগর' সিনেমার কথা......এক আটপৌরে গিন্নীর 'রোজগেরে গিন্নী' হওয়ার সামাজিক ও মানসিক টানাপড়েনের লড়াই। কোথাও গিয়ে হয়ত এই Identity Crisis এ ভোগা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মহিলাদের লড়াই আর নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী মহিলাদের 'মেমসাহেব (নাকি রিনা ব্রাউন?)' হয়ে ওঠা কাহিনী মিলে যায়। মনে পড়ল মিসেস মজুমদারের পার্সের সেই অ্যাংলো বন্ধুর দেওয়া সেই 'নিষিদ্ধ' লিপস্টিকটার কথা...... যে রঙে রাঙ্গিয়েই হয়ত বাঙ্গালী মহিলাদের 'স্বাধীন' হওয়ার গল্প শুরু। ......... এ নিয়ে বিতর্ক হয়ত চলবে......। তা চলুক। আমি ফিরি Weston Street এ। দুএক মিনিট straight গিয়ে... লেফট নিতেই পেলাম Bow Street ও Bow Barrack.
কলকাতার অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের ইতিহাসের তুলনায় বো ব্যারাকের ইতিহাস অপেক্ষাকৃত নতুন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতায় আগত আমেরিকান সৈন্যদের জন্যে তৈরি হয়েছিল এই ব্যারাক অর্থাৎ মেস বাড়ি। তবে জায়গাটি সৈন্যদের নাপসন্দ হওয়ায় তারা এখানে থাকেনি। আর সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই জায়গাটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারদের থাকার জন্যে বরাদ্দ হয়। আর সেই থেকেই এদের বাস এখানে। উইকিপিডিয়া বলছে প্রায় ১০০ র ও বেশী অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবার থাকেন এখানে। উজ্জ্বল লাল রঙের দেওয়ালে ছোট ছোট মেসবাড়ি সঙ্গে মানানসই সবুজ জানলা। রোজনামচার চলমান জীবনের ছাপ যথেষ্টই। ছোট ছোট দালানে বেশ কিছু অ্যাংলো মহিলারা গল্পে মসগুল। তাদের মধ্যে একজন আমার হাতে ক্যামেরা দেখে খিচিয়ে উঠলেন 'No photograph'। না ওনাদেরকে আর বিরক্ত করিনি। বরং বেশ কিছু কচিকাঁচাদের সাথে আলাপ হল। চার্চের গলিতে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ তাদের ফুটবল খেলা দেখলাম। বিশ্বকাপের জ্বর এখানেও...... আর্জেন্টিনার জার্সি পরে এক খুদে ও তার হাবভাব.........ওঃ দারুণ! চার্চের গলিতেই একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোকের সাথে আলাপ হল...। জানা গেল... প্রায় তিন পুরুষ আছেন তারা ওখানে। তবে এই মেসবাড়ির জনসংখ্যা মেসবাড়ির অবস্থার মতো ভগ্নপ্রায়। ভদ্রলোকের থেকে জানা গেল 'ওনাদের অনেকেই এখন অস্ট্রেলিয়া, নিউজিলান্ড -এ থাকেন। অবশ্য মাটির টান অনুভব করেন বলেই ক্রিসমাসে 'বাড়ি' ফেরেন...... বছরে একবার। তবে সে সংখ্যা দিনে দিনে কমছে। তবু এখনও বর্তমান 'Bow United Organisation' -- খেলা থেকে হেলথ চেক আপ, ক্রিসমাস সংগঠন আরও কত কি। মিনিট কুড়ি-পঁচিশ হাঁটাহাঁটি করলাম। আশ্চর্য লাগলো ঐ একই পাড়ায় একটি পার্সি ধরমশালা আর একটি বুদ্ধিস্ট ধরমাঙ্কুর পাওয়া গেল। অ্যাংলো, বৌদ্ধ, পার্সি ......সব মিলিয়ে বেশ একটা 'দ্রাবিড়- উতকল-বঙ্গ' টাইপের ক্রিসমাস ক্যারল।
ফিরে আস��র সময় ঐ ভদ্রলোকের সাথে আবার দেখা। হাত নেড়ে বললেন 'Visit here during Christmas, you will love the environment'। ক্রিসমাস দেরী আছে............ তবে খুব শিগগির আর একবার যাব ওখানে। শুনেছি নাকি ভোরবেলায় ওখানে ভিস্তিওয়ালারা জল দেয় এখনও। আর আছে ওখানকার বাড়িতে তৈরি কেক, বিস্কুট আর ওয়াইন...। সঙ্গে থাকুক সেই 'পুরনো গিটার' আর The Anglo-Indian Way বন্দে মাতরম (https://www.youtube.com/watch?v=hiBoC8bNAWs)।
0 notes
Text
দুই তারার ঝিকিমিকি
সোপান কর্মকার- নিজের পদবীর মর্যাদা রেখে সোপান যাকে বলে 'হও কর্মেতে বীর' টাইপের - বিদ্যায়, বুদ্ধিতে ওই যাকে বলে 'সরস্বতীর বরপুত্র'। 'ভালো ছাত্র' বলে চিরকাল-ই একটা সুনাম ছিল সোপানের। সেই 'ভালো ছাত্রের' তকমা আজ সোপানের প্রধান অন্তরায়। বছর দুই আগে কলকাতার একটি নামকরা কলেজ থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সোপান আপাতত বেকার। কারোর অধীনে চাকর হওয়ার 'স্বাধীনতা' (মোদ্দা কোথায় 'চাকরি') না পেলে আশেপাশের পৃথিবীটা যে এতটা বদলে যেতে পারে সেটা বোঝার জন্য এই দুটো বছর সোপানের কাছে যথেষ্ট। বন্ধু বান্ধবদের কিছু 'সোজা সাপটা মন্তব্য', কলেজের স্যার-দের টুকটাক 'বাঁকানো মন্তব্য' আর বাড়ির লোকেদের 'আপাত সাবধানী কিন্তু ঠেস যুক্ত মন্তব্য' শুনতে শুনতে সোপান সত্যিই এখন 'মেকানিক্যাল' ('ইঞ্জিনিয়ার না 'মানুষ', সেটা মাঝে মাঝে গুলিয়ে যায়')। আপাতত সোপান চলেছে লুধিয়ানা। একটি কোম্পানি-র কন্ট্রাক্ট এর কাজের ইন্টারভিউ। ইন্টারনেট-এর জব সাইট থেকে থেকে কোম্পানিই সোপানকে ফোন করে। সোপান না বলতে গিয়েও পারেনি। কলকাতা থেকে পাঞ্জাবের পথেই নাকি সুভাষচন্দ্র পালিয়েছিলেন......স্বাধীনতার তাগিদে। আজ সোপানও যে পালাচ্ছে কলকাতা ছেড়ে - 'কিছুটা পরাধীনতার দায়েই......... চাকর যে তাকে হতেই হবে।'
পথিকৃৎ চক্রবর্তী - বাংলা আধুনিক সাহিত্যের খ্যাতনামা লেখক। বয়স আনুমানিক পঞ্চাশের ওপরে। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকখানি ছোটগল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাসের স্রস্টা। প্রাপ্তবয়স্কদের থেকে উনি কিশোরদের কাছেই বেশি প্রিয় - ওনার ক্রাইম থ্রিলার বইগুলোর জন্য। ওনার সৃষ্ট চরিত্র 'ইন্সপেক্টর সাত্যকি বোস' গত কয়েক বছরে বাংলার কিশোর মহলে যাকে বলে 'হটকেক'। সাত্যকি বোস-- শবর নন ... ফেলুদা বা ব্যোমকেশ তো নন-ই। বরং ওনার সাত্যকি খানিকটা 'সলমন খান' খ্যাত 'চুলবুল পাণ্ডে', কিছুটা 'নবাব' খ্যাত 'রঞ্জিত মল্লিক' আর কিছুটা 'ক্যাপ্টেন আমেরিকার' সংমিশ্রণ। পথিকৃৎ চক্রবর্তীর পদবীটি আসল হলেও 'পথিকৃৎ' নামটি কিন্তু ছদ্মনাম। মানুষ হিসেবে পথিকৃৎবাবু ওই সাত্যকি বোসের ঠিক উল্টো। চিরকালীন প্রচার বিমুখ, স্বল্পভাষী আর ঘরোয়া টাইপের মানুষ। ফি সপ্তাহে দু-তিন বার বাজারে আর ফি মাসে এক বার সম্পাদকের অফিসে, ব্যস এটুকুই। বইমেলাতে নিজের বইয়ের উদ্বোধনে সর্ব সাকুল্যে গেছেন তিন বার - ছিলেন ঘড়ি ধরে মিনিট কুড়ি। ইন ফ্যাক্ট ওনার বইতে নিজের কোনও ছবিও উনি দেন না, বলেন - 'আমি কিরকম দেখতে তার সা���ে বই এর কি সম্পর্ক?' গেল রোববারে আনন্দবাজারের পাতায় তাঁর ওপর একটি লেখাতে জানা যায় যে নামকরা প্রযোজক সংস্থা খুব শিগগির এই সাত্যকি বোসকে রুপোলী পরদাতে পেড়ে ফেলতে চায়। তবে পথিকৃৎ বাবু ঘোর আপত্তি জানিয়ে মন্তব্য করেন 'মানিকবাবু হলে না হয় কথা ছিল, কিন্তু এসব খুচরো ব্যাবসায়ী-দের কাছে উনি ওনার চরিত্রগুলিকে বিক্রি করবেন না।' সংবাদপত্র এও জানিয়েছে যে এহেন মানুষটি গত চার বছর আগে স্ত্রী গত হওয়ার পর থেকে অন্ত্র নালীর সমস্যায় ভুগছেন , তাই স্বাভাবিক কারণে লেখার গতি কম এবং সম্পাদকদের তাড়া বেশি। সামনের পুজোতে ওনার তিনটে লেখা বেরোনোর কথা...... যার একটিও এখনও শেষ হয়নি। ভেবেছেন কোথাও একটা নির্ভেজাল মাসখানেকের অজ্ঞাতবাসে গিয়ে লেখা গুলো শেষ করবেন।
*********
অমৃতসর মেল হাওড়া ছেড়েছে প্রায় ঘণ্টাখানেক। স্লিপার ক্লাসের একটি সাইড লোয়ার বার্থে আধশোয়া অবস্থায় জানলার বাইরে 'গতিমান' ট্রেন লাইনগুলোকে দেখছিল সোপান। প্রতি মুহূর্তে অনেক কিছু কেমন যেন পিছিয়ে যাচ্ছে...। খুব রাগ হচ্ছিল ওর নিজের শহরটার ওপর। এত বড় শহরটা সোপানকে আটকে রাখার একটাও কারণ খুঁজে পেল না। চেষ্টার তো কোনও ত্রুটি রাখেনি সে। জানলা থেকে মুখ ফেরাল সোপান। উলটোদিকের ছটা বার্থে বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে আট জনের এক অবাঙালী পরিবার......নিজেদের মধ্যে গল্পে মসগুল...... মনে হয় বেড়াতে যাচ্ছে। সোপানের আপার বার্থ খালি ...। সামনের কোনও স্টেশন থেকে লোক উঠবে বোধহয়। ব্যাগ হাতড়ে সমরেশ মজুমদারের 'বৃষ্টিতে ভেজার বয়স' বইটা বার করে একটা ভাঁজ করা জায়গা থেকে পড়তে শুরু করল। বইটা সোপানের আহামরি কিছু প্রিয় বই নয়। তাড়াহুড়োতে এই বইটাই হাতের কাছে পেয়ে ঢুকিয়ে নিয়েছে। তাই বিরক্তিতে হোক বা ক্লান্তিতে, দু তিন পাতা পড়ার পরই ঘুমিয়ে পড়ল সোপান ।
বই পড়া সোপানের একমাত্র নেশা। মাজে মধ্যে দু এক পিস সিগারেট অবিশ্যি খায় সে তবে 'বই' তার কাছে 'ন্যাওটামির শেষ কথা।' বিখ্যাত, কুখ্যাত, উঠতি, পরতি, ঝরতি -- কারোর বইই বাদ দেয় না সে। এব্যাপারে তার 'লাইব্রেরী' হল পাড়ার রাতুলদা আর মাঝে মধ্যে কলেজ স্ট্রিট......... বইপাড়ার ওই প্লাস্টিক বিছনো পুরনো বই -- সোপানের ভাষায় 'কলকাতার বসন্ত গলি'। এ হেন সোপানকে ওই রাতুলদাই দিয়েছিল একটা বই, সে প্রায় বছর পাঁচেক আগে -- নাম 'ইস্কাপনের গোলাম' , লেখক - পথিকৃৎ চক্রবর্তী। মোটামুটি দেড় দিনে বইটা শেষ করে সোপান বুঝেছিল এ হল গিয়ে বাংলা সাহিত্যের বিশ্বায়ন। লাল বাজারের একজন বাঙ্গালি ইন্সপেক্টর সেখানে মার্ডার মিস্ট্রি সল্ভ করতে গিয়ে একবালপুর থেকে সিঙ্গাপুর ছুটছে, মার্ডার মিস্ট্রির সাথে মিশেছে সাইবার ক্রাইম --- সে এক রমরমা ব্যপার, তবে শেষ অবধি সেই 'ওই থোর বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোর'। তারপরেও ওই লেখকের আরও দুটো বই পড়েছে সোপান --- কিছুটা রাতুলদার কল্যাণেই। রাতুলদা যে ওই 'ইন্সপেক্টর সাত্যকি বোস' এর জম্পেশ ফ্যান। সোপান বুঝেছিল যে চক্রবর্তীবাবু অনেক বিখ্যাত লেখকদেরদের ক্রাইম থ্রিলারগুলোকে নিয়ে বেশ একটা 'সিনেমাটিক ঝালমুড়ি' বানিয়েছেন। পড়তে খারাপ না লাগলেও তারপরে প্রায় বছর তিনেক হয়ে গেল বসন্ত গলিতে গিয়ে চক্রবর্তীবাবুর কোনও বইয়ের খোঁজ আর করেনি সোপান।
'এই যে উঠুন ! 'লোয়ার বার্থটা আমার' ' -- পিঠের কাছে আলতো টোকায় ঘুম ভাঙল সোপানের। ঘুম চোখে তাকিয়ে বছর পঞ্চাশের এক ভদ্রলোককে দেখল সোপান। ঝুফো গোঁফ, ব্যাকব্রাশ করা কাঁচা পাকা চুল, চোখে চশমা, পিঠে ঝোলা ব্যাগ, হাতে একটি সুটকেস।
সরি... বলে পা গুটিয়ে বসল সোপান। সুটকেসটিকে সিটের তলায় চালান করে দিয়ে ভদ্রলোক বসলেন উলটোদিকে।
'ট্রেন কি লেটে ছেড়েছে?'
সোপান বুঝল প্রশ্নটি তাকেই করা হয়েছে। সংক্ষেপে উত্তর দিল 'হ্যাঁ... আধঘণ্টা'।
'আরও ঝোলাবে। এই লাইনের এটাই সমস্যা।' -- ভদ্রলোক বললেন।
ট্রেন আসানসোল স্টেশন না পেরোতেই ভদ্রলোক স্লিপার টিপার বার করে, বাথরুমে গিয়ে চেঞ্জ করে এলেন। বেশ জুত হয়ে বসে কাঁধের ঝোলা ব্যাগটার থেকে একটা খাতা বের করে নোট করার ভঙ্গিতে সোজাসুজি প্রশ্ন করলেন সোপানের দিকে - 'কদ্দুর যাবেন?'
একটু থতমত খেয়ে সোপান বললও - 'মানে? ও মানে লুধিয়ানা...।'
'ওরেব্বাস! বাঙ্গালির পাঞ্জাব ভ্রমণ। আমি যাচ্ছি লখনউ। নবাব ওয়াজিদ আলী শাহের জরুরি তলব...... হা হা'।
'তা আপনি কি বেড়াতে? তা লুধিয়ানা আবার ভ্রমণ স্থল হল কবে থেকে?'
সোপানের বিরক্তিটা বাড়ছিলো। কাঁচা ঘুম থেকে ডেকে তূলে এরকম বাজে প্রশ্নের উত্তর দিতে একেবারেই ভালো লাগছিলো না ওর।' অনিচ্ছাসত্ত্বে বলল 'চাকরীর ইন্টারভিউ আছে।'
'বাব্বা...... কোলকাতায় চাকরী কি কম পড়িয়াছে, যে মহাশয়কে পাঞ্জাব পাড়ি দিতে হচ্ছে'?
ঘি পড়লো আগুনে।
দপ করে জ্বলে উঠলো সোপান -- 'না কম পড়েনি, ঢেলে রাস্তায় বিকোচ্ছে, আসলে কি জানেন...... আমার কলকাতার রাস্তাঘাট ভালো চেনা নেই তো, তাই খুঁজে পাচ্ছি না' -- এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বলে থামল সোপান।
'এই রে। মহাশয় কি রেগে গেলেন?'
'দেখুন আমার শরীরটা খারাপ। আমাকে একটু চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে দেবেন প্লিজ। অবিশ্যি আপনার আপত্তি থাকলে আমি ওপরের বার্থে চলে যেতে পারি' -- সোপান বলল।
'আহা তা কেন... তা কেন...! আপনি এখানেই বসুন। আমাদের পরিচয়পর্বটা না হয় কিছুক্ষণের জন্য স্থগিত থাক। আপনি আছেন... আমিও আছি......। ট্রেন থেকে আর কোথায় যাব...... হে হে!।
মিনিট পাঁচেক ওখানেই বসে থেকে, সোপান ওপরের বার্থে উঠে গিয়ে শুয়ে পড়ল। ঘড়িতে তখন প্রায় সাড়ে আটটা।
**************
সোপানের ঘুম যখন ভাঙল তখন ঘড়িতে দশটা পঁয়ত্রিশ। বেশ খিদে পেয়েছে। বাথরুমে গিয়ে মুখে চোখে জল দিয়ে আবার ওপরের বার্থে উঠে গেল সোপান। ব্যাগ থেকে টিফিন বক্স খুলে রাতের খাবার খেয়ে আবার একবার নীচে নামল সে। নীচের বার্থের ভদ্রলোককে কিছুটা উপেক্ষা করেই বাথরুম থেকে ঘুরে এসে ওপরের বার্থে ওঠার সময় মনে পড়ল সমরেশ মজুমদারের বইটার কথা -- যেটা নীচের বার্থেই থাকার কথা। ভদ্রলোক শুয়ে পরেছেন দেখে আর ঘাঁটাল না। উঠে গিয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল বটে, কিন্তু অন্ধকার কামরার ওই 'নীল নির্জনে' পরিবেশেও সোপানের ঘুম আসছিল না। কিছুক্ষণ মোবাইল খুলে ঘাঁটাঘাঁটি করে বুঝল যে টাওয়ারের অবস্থা সঙ্গিন। ফেসবুকের পুরনো পোষ্টগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে একজায়গায় সোপানের দুপুরের বিরক্তিটা তিনগুণ বেড়ে গেল। পোষ্টটি সোপানের কলেজের জনৈক বন্ধু শ্রীমান অনিন্দ্য সরকারের, যিনি বাঙ্গালোরে একটি কোম্পানিতে চাকরি প্রাপ্তি-র খবর ফলাও করে পোস্টিত করেছেন এবং তাতে অভিনন্দনের বন্যা বয়ে গেছে। অনিন্দ্যর সেমেস্টার প্রতি কমপক্ষে দুটি ব্যাক পেপার থাকতো যা সে কোনক্রমে ক্লিয়ার করে ফাইনাল সেমেস্টার-এ। অন্যদিকে সোপান সবমিলিয়ে ওদের ব্যাচের মধ্যে নবম স্থানে ছিল। লুধিয়ানার চাকরিটা আর একবার থাবা বসাল সোপানের মাথায়। 'চাকরিটা তাকে পেতেই হবে'। বুকের মধ্যের ধুকপুকানিটা টের পেল সে। চাকরিটা যদি না হয় তাহলে...? আবার সেই কলকাতায় ফেরা......আর একগুচ্ছ প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া। কামরার নীল আলো গুলো থাকা সত্ত্বেও অন্ধকারটা যেন বেশি লাগতে শুরু করল সোপানের।
কখন ঘুমিয়েছে সোপান তা জানে না। কিছু মানুষের হাঁক ডাকে ঘুমটা ভাঙল। ট্রেনটা থেমে আছে এবং কামরার প্রত্যেকটা আলোই তখন জ্বলছে। আর কিছু লোক উচ্চস্বরে কীসব নিয়ে আলোচনা করছে। উকি মেরে দেখল নীচের বার্থের ভদ্রলোক বসে জানলা দিয়ে বাইরে উঁকি দিচ্ছেন। ঘড়ি বলছে তিনটে বাজতে পাঁচ। নিচে নেমে এলো সোপান। নামতেই নীচের ভদ্রলোক বললেন - 'মনে হচ্ছে ইঞ্জিনটা গেছে। গত দেড় ঘণ্টা ধরে ট্রেনটা এখানেই দাঁড়িয়ে আছে।' বাইরে উঁকি ঝুঁকি মেরে কিছুই বোঝা গেল না।
'কি কাণ্ড... বলুন তো? ��খন এই রাতদুপুরে কতক্ষণে ইঞ্জিন আসবে কে জানে?' শুধলেন ভদ্রলোক।
সোপান কোনও উত্তর না দিয়ে উঠে পড়ল টি টি বাবুর সন্ধানে। মিনিট দশেক খোঁজার পর টিটিবাবুর থেকে যা জানা গেল তা সংক্ষেপে হল এই যে 'ট্রেন বক্তিয়ারপুর আর ফাতা নামে কোনও স্টেশনের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। পাটনা জংশনে খবর পাঠানো হয়েছে। ইঞ্জিন আসতে ভোর হয়ে যাবে।' ফিরে এসে ভদ্রলোককে খবরটা দিল সোপান। নীচেই বসল... ওপরে বেশ গরম আর ভদ্রলোক ঘুমোবেন বলে তো মনে হচ্ছে না।
'এই নিন, এটা মনে হয় আপনার?' ভদ্রলোকের হাতে সমরেশের বইটা।
'ওহ থ্যাংকস'
'পড়েছেন বইটা? কেমন লাগলো?' --শুধলেন ভদ্রলোক।
'পুরোটা পড়িনি, যতটা পড়েছি তাতে তো খুব একটা আহামরি মনে হচ্ছে না। -- সোপানের উত্তর।
'পুরোটা পড়ুন । সমরেশদার বই বলে কথা। আমার পড়া বইটা। বেশ ভালো। -- ভদ্রলোক বললেন।
'সমরেশদা?' -- শুনে থমকাল সোপান। এমন ভাবে বলছে যেন পাড়ার দাদা। যতসব আঁতলামি আর কি। সত্যজিৎ রায় কে অনেকে আবার 'মানিকদা' বলে --- বিশেষ করে কিছু আঁতেল সিনেমা পরিচালকেরা। শুনলে গা জ্বলে যায় সোপানের। আর সমরেশবাবুর বই বলেই কি ভালো বলতে হবে নাকি। ভালো লাগা তো ব্যক্তিগত ব্যাপার। মনে মনে ভাবল 'চেপে ধরবে নাকি ভদ্রলোককে...... দেখা যাক কত বই উনি পড়েছেন' ......
ভদ্রলোক বলেই চলেছেন --- 'আর শুধু সমরেশদাই কেন...... সুনীল থেকে ষষ্টিপদ বা শরদিন্দু থেকে সত্যজিৎ ----- কাকে ছেড়ে কার কথা বলি? বাংলা ভাষা তো ক্রাইম থ্রিলারের পীঠস্থান।'
'আলবাত...। তবে যাদের নাম আপনি করলেন কেবল তাদেরকে দিয়ে বাংলা ভাষার ক্রাইম থ্রিলার বিচার করলে কিন্তু ভুল হবে। আপনি ঠিক ই বলেছেন ---- বাংলা ভাষায় সমরেশবাবুর মতো ক্রাইম থ্রিলার আর কজন লিখেছেন? তার মানে এই নয় যে আমি ব্যোমকেশ, কাকাবাবু, ফেলুদা, ঋজুদা, কিরীটী পড়ি না। পড়ি এবং ভীষণ ভাবেই পড়ি। আপনিও মনে হচ্ছে ক্রাইম থ্রিলার বেশ পড়েন। আচ্ছা বাংলা ভাষায় মৌলিক গোয়েন্দা গল্পের জনক কাকে বলা যেতে পারে বলুন তো !'-- সোপান উত্তেজিত।
'শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় নিশ্চয়ই' --- ভদ্রলোক শুধলেন।
'না স্যার। শরদিন্দুবাবু 'সত্যান্বেষী' লেখেন ১৯৩৩-৩৪ এ। আর আমি বলছি ১৮৯১-সালের প্রিয়নাথ মজুমদারের কথা...... যিনি প্রায় ২০০-টির ও বেশি কিস্তিতে লেখেন 'দারোগার দপ্তর'। এছাড়াও তার পরের ২০-৩০ বছরে দীনেন্দ্র কুমার রায়ের 'অজয় সিংহের কুঠি', কালীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়ের 'বাকাউল্লার দপ্তর' কিম্বা পাঁচকড়ি দে........ আর কত বলব। ব্রিটিশ শাসিত বাংলায় বিভিন্ন মাসিক পত্রিকায় রোমান্স-অ্যাডভেঞ্চার-ক্রাইম সবকিছুর ককটেল বানিয়ে রীতিমতো সিরিজ করে বেরত সেসব গল্পগুলো...... অবশ্যই বাংলা ভাষায়।' ---- থেমে থেমে বলল সোপান।
কয়েক সেকেন্ড বিরতির পর ভদ্রলোক গলা খাকড়িয়ে উত্তর দিলেন - 'ও বাবা, তুমি থুড়ি আপনি তো দেখছি ক্রাইম থ্রিলার অমনিবাস।'
'তুমি টাই থাকুক না...। আপনি তো আমার থেকে বেশ অনেকটাই বড়' --- ঈষৎ খোঁচা সোপানের।
'বেশ বেশ । তা এত পড়া হয় কখন? আজকাল তো শুনি সবাই খুব ব্যস্ত...... বই পড়ার সময় নেই। ই-বুক না কি ওসব ডাউনলোড করে রাখে কিন্তু পড়ে না......।" ---- খোঁচাটা বেমালুম হজম করে গেলেন ভদ্রলোক।
'দেখুন মশাই, বই পড়ার জন্য সময়... ইচ্ছে থাকলেই বেরিয়ে আসে। আর আমার কথাই যদি বলেন... মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছি বছর দু আগে। আর এই দু বছর ধরে বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে চাকরি খুঁজছি। ��লকাতায় একটা অফার পেয়েছি তাও পাঞ্জাব যাচ্ছি জাস্ট একবার বাজিয়ে দেখতে যে ওরা কত স্যালারি অফার করে' ---- অনেকদিন বাদে এভাবে উত্তর দিতে পেরে সোপানের বেশ ভালো লাগছিল। উত্তেজনার বশে কয়েকটা মিথ্যে কথা গুলোও বেশ জোরের সঙ্গেই বলল সে।
'বাঃ বাঃ খুব ভালো। পড় পড় আরও পড়। তা হালের নতুন লেখকদের লেখাও পড় নিশ্চয়ই।' --- ভদ্রলোকের গলায় ঔৎসুক্য।
'হ্যাঁ ... তাও পড়ি। আর হালের লেখকদের কথাই যদি বলেন, তাহলে বলি ওই দু একজন ছাড়া সবাই সেই 'ওই থোর বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোর'। সে আপনি সুবিনয় বসাক বলুন বা সংযুক্তা মুখোপাধ্যায় বলুন বা পথিকৃৎ চক্রবর্তী? ঝালমুড়ি মশাই ঝালমুড়ি'।
'অ্যাঁ... বল কি হে!' -- ভদ্রলোক চমকালেন।
'তা নয়ত কি? তার মধ্যে এই পথিকৃৎ চক্রবর্তী মহাশয় তো আবার এক কাঠি ওপরে...। ওনার মূল চরিত্র, কি যেন এক ইন্সপেক্টর, সে তো তো আবার হিন্দি ফিল্মের নায়কদের আদলে তৈরি। ভাবা যায়...। মুখরোচক করতে গিয়ে কি না করছেন কে জানে...'। এর চেয়ে লালমোহন বাবু ঢের গুনে ভালো ছিলেন।'
আলোচনা জমে উঠেছিল। ছেদ পড়ল একটা ঝাঁকুনিতে। ইঞ্জিন লেগেছে। এবার বুঝি ছাড়বে ট্রেন। সোপান আর কথা না বাড়িয়ে ভদ্রলোককে বলল 'ঘুমিয়ে পড়ুন, সকালে কথা হবে'। আর মনে ��নে ভাবল 'যা দিয়েছি ওনাকে আর বিরক্ত করার সাহস দেখাবেন বলে তো মনে হয় না।'
ট্রেন ছাড়ল। যুদ্ধ জয়ের তৃপ্তি নিয়ে ঘুমোতে গেল সোপান। ঘড়িতে তখন প্রায় পৌনে পাঁচটা।
**************
রাত্রে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল সোপান। সে দেখল যে সে কলেজ স্ট্রিটের রাস্তায়। মেডিকেল কলেজের দিকের ফুটপাথে রাতুলদা বসে আছে প্লাস্টিক বিছিয়ে আর হাঁক দিচ্ছে 'চাকরি নিয়ে যান চাকরি...... নতুন চাকরি জলে দরে...... মাত্র একশো টাকা...।' সেই দেখে একদল লোক ছুট লাগাল রাতুলদার দিকে। সোপানও ছুটতে চাইল কিন্তু কিছু পাগড়ি পরা শিখ লোক তাকে শক্ত করে ধরে বলছে 'চল বেটা লুধিয়ানা... বল্লে বল্লে'। সোপানের মরিয়া চিৎকারে কেউ কান দিচ্ছে না। আস্তে আস্তে রাতুলদার থেকে সবাই 'চাকরি' কিনে চলে গেল... দাঁড়িয়ে রইল সোপান একা। কে বা কারা যেন সেই ছবি তুলে ফেসবুকে দিয়েছে আর তাতে একগুচ্ছ স্মাইলি সহ কমেন্ট পড়েছে ' R.I.P সোপান কর্মকার' এবং সেই লিস্টে প্রথম কমেন্টটাই শ্রীমান অনিন্দ্য সরকারের'।
ঘাম দিয়ে ঘুম ভাঙল সোপানের। কামরায় তখন চা-ওয়ালাদের বিস্তর হাঁক ডাক। ধড়মড় করে উঠে বসল সে। ঘড়িতে তখন প্রায় সওয়া ন টা। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে আস্তে আস্তে নীচে নামল। বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে জলের ঝাপটা দেওয়াতে অসোয়াস্তিটা কিছুটা কাটল। এক কাপ চা কিনে দরজার সামনে দাঁড়িয়েই খেল সে। একগুচ্ছ লোকের ভিড় সেখানে। তাও সোপান ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল, নিজের বার্থে আস্তে ইচ্ছে করছিল না তার। ট্রেন কোনও এক স্টেশনে ঢুকছে। নাম দেখল - দিলদারনগর জংশন। নামা ওঠার ভিড় কমলে স্টেশনে নামল সোপান। মনে পড়ল ওই নীচের বার্থের ভদ্রলোকের কথা। উনি কি নেমে গেলেন? ভাবতেই দরজার পাশে টাঙ্গানো রিসারভেশন চার্টটার দিকে নজর গেল সোপানের। দেখল ভদ্রলোকের নাম মিঃ এস চক্রবর্তী, বয়স ৫২ আর উনি নামবেন লখনউ। ট্রেন নড়ে উঠতেই ...... উঠে পড়ল সোপান। বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে যখন বার্থে ফিরল...... ততক্ষণে ওই ভদ্রলোক উঠে পড়েছেন। উলটোদিকের ওই বেড়াতে যাওয়া পরিবারের একজনের সাথে এক চা-ওয়ালার খুচরো নিয়ে অল্প বিস্তর কথা কাটাকাটি চলছে। সোপান কে দেখেই ভদ্রলোক শুধলেন 'গুড মর্নিং, রাতে ঘুম হয়েছে? আপাতত ট্রেন চার ঘণ্টা লেট, মানে লখনউ ঢুকতে ঢুকতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে।' প্রত্যুত্তরে সোপান শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে নিজের বার্থে উঠে ওই সমরেশ বাবুর বইটা খুলে পড়তে সুরু করল। সম্বিত ফিরল ভদ্রলোকের ডাকে। 'এসো ব্রেকফাস্ট টা সেরে ফেলি।'
নিচে নেমে সোপান দেখে যে মিঃ চক্রবর্তী দু প্যাকেট খাবার নিয়ে বসে আছেন। ট্রেনের থেকে কেনা ব্রেকফাস্ট......
লজ্জা পেয়ে সোপান বলল - 'আরে আপনি আবার এসব......।"
'কী বলছ...। কাল রাতে তোমার যা পড়াশুনো দেখলাম......ধরে নাও তাতে খুশি হয়ে প্রাইজ দিচ্ছি...... হা হা ! নাও শুরু কর। আর হ্যাঁ...... তোমার সাথে কিছু কথা আছে --- সেটাও একটা কারণ বইকি...। চলো ...। খেতে খেতে কথা বলা যাক'।
কথা না বাড়িয়ে প্যাকেটটা খুলল সোপান। খিদে তো পেয়েছে। বলল - 'বলুন কী কথা?'
এক টুকরো পাউরুটি মুখে চালান করে দিয়ে মিঃ চক্রবর্তী বললেন -- 'আমার নামটা তোমায় বলা হয়নি'। বেশ আগে তোমার নামটা শুনি তারপর আমারটা বলছি -----"
থামিয়ে দিয়ে সোপান বলল--- "আমার নাম সোপান কর্মকার। আর আপনার নামটা আমি জানি......... মিঃ এস চক্রবর্তী, বয়স ৫২।"
"ও বাবা তুমি কী গোয়েন্দা নাকি হে? কী করে জানলে ......! ওহ বুঝেছি......... রিসারভেশন চার্ট দেখেছ। তবে আমার ওই নামটা তোমার কাছে চেনা নয়। আমার যে নামটা তুমি চেন সেটা হল গিয়ে পি চক্রবর্তী... ওরফে পথিকৃৎ চক্রবর্তী। পথিকৃৎ আমার ছদ্মনাম...। আমার আসল নাম সুজিত চক্রবর্তী।'
অমলেটের টুকরোটা হাতেই ধরা রইলো সোপানের। নিজের কানকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। ............পথিকৃৎ চক্রবর্তী...... লোকটা বলে কী...।! না জেনেই সে কাল রাতে কত কিছু বলেছে ভদ্রলোকের নামে...। বই অনেক পড়েছে সোপান......। তবে সাহিত্যিক দের সাথে আলাপ প্রায় কোনদিন তার হয়নি। একবার বইমেলায় বুদ্ধদেব গুহ কে দেখেছিল সে......তাও ভিড়ের মধ্যে। এই রকম একজন বিখ্যাত সাহিত্যিকের সাথে বসে ডিম-পাউরুটি খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছে ----- ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি। রাতুলদার থেকে শুনেছিল .পথিকৃৎ চক্রবর্তী.র কথা, তার হট সেলিং বই গুলোর কথা।
সম্বিত ফিরল পথিকৃৎ বাবুর ডাকে। 'কি হল হে...। যাকে কাল রাতে গাল পারলে তাকে সামনে দেখে অস্বস্তি হচ্ছে?'।
'না মানে তা নয় ঠিক' --- সোপান থতমত।
'এবার তুমি আমাকে প্রশ্ন করতে পারো যে আমি তোমাকে আমার পরিচয় দিলাম কেন? এমনিতে আমি কোনও বইতে আমার ছবি দিই না। জানো নিশ্চয়ই। পরিচয় দিলাম...... কারণ পাঠক হিসেবে তোমার কতকগুলো কথা জানা দরকার। বা আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে 'আমার বলা দরকার'। আচ্ছা! আমার কটা বই পড়েছ তুমি?' -- চক্রবর্তীবাবু জিজ্ঞাসা করলেন।
'অ্যাঁ... মানে তিনটে...। মানে ওই 'ইস্কাপনের বিবি, জলের তলায় খুন ......... আর একটার নাম ভুলে গেছি --- অনেকদিন আগে পড়েছি ' সোপানের সাবধানী উত্তর।
'হা হা ... একটুকরো অমলেট মুখে ফেলে বললেন চক্রবর্তীবাবু - 'সবে তিনটে...... আর এই নিয়ে তুমি আমাকে তুলোধোনা করছ।' --- ভদ্রলোকের ঠোঁটের কোণায় হাসি।
কি একটা নাম না জানা স্টেশন পেরচ্ছে ট্রেনটা। প্রমাদ গুনল সোপান। এবার ভদ্রলোক কাল রাতের কথার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক কিছু বলবেন। কেন ওনার গল্প গুলো লোকে এত পড়ে, সেই নিয়ে একগাদা কথা বলবেন। কি উত্তর দেবে সেটাই ভাবছিল সোপান...।!
ভদ্রলোকই বললেন -- 'আচ্ছা ঠিক কি ভালো লাগে না বল তো আমার লেখাতে? তুমি তো বেশ অনেককিছুই পড়েছ বলে মনে হচ্ছে।'
প্রথমে সোপান ভাবল একটু বিনয় করে ব্যাপারটা এড়িয়ে যাবে। কিন্তু কোথাও গিয়ে রাতের কনফিডেন্স তা ফিরে এলো। বলল - 'দেখুন আপনার লেখা যে একেবারেই পড়া যায় না তা কিন্তু আমি বলিনি। বেশ টাইট লেখা আপনার। দুটো ব্যাপার যা আমার মনে ধরে নি সেটা হল আপনার লেখার চরিত্র গুলো বেশ সিনেম্যাটিক...... '
'তাই? যেমন?' -- একটু যেন ঝাঁঝিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন ভদ্রলোক।
'এই যেমন ধরুন আপনার হিরো...কি যেন নাম... হ্যাঁ...সাত্যকি বোস...ওই ইস্কাপনের বিবি গল্পে একটা লারজার দেন লাইফ চরিত্র। সে কাসিনো তে গিয়ে গ্যাম্বলিং খেলতে পারে, মোটর সাইকেল থেকে লাফিয়ে গাড়িতে উঠতে পারে, আবার পাইপ খেতে খেতে কম্পিউটারে বসে প্রোগ্রাম ডিকোড করে, আবার মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্ব নিয়ে ঝাড়া লেকচার দেয়। পুরো হিন্দি সিনেমার হিরো...।' -- একটু থামল সোপান।
'বলে যাও' -- ভদ্রলোক চা এর ভাঁড়ে একটা চুমুক মেরে বললেন।
'তারপর ধরুন, সাত্যকির ওই অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার, নামটা ভুলে গেছি...। তাকে দিয়ে ওরকম ভাঁড়ামি করার কোনও মানে হয়। কমিক রিলিফ দেবেন দিন ... তাই বলে এরকম? দেখুন অজিত বা লালমোহনের..... নিজ নিজ গল্পে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল...... সত্যজিৎ বা শরদিন্দু এদের কে মোটেই 'কমিক রিলিফ' করে ব্যবহার করেন নি। আসলে এদের চলচিত্রায়ন করতে গিয়েই......... '-- থামল সোপান কারণ ভদ্রলোক বলে উঠেছেন।
'না ঠিক তা নয়। সিনেমার প্রতি আমার আসক্তি চিরকালই কম। ইন ফ্যাক্ট আমি চাইও না যে আমার গল্প গুলো নিয়ে সিনেমা হোক। তবে কি জানো... টিভি আর ইন্টারনেটের যুগে লিখছি তো...... কিছুটা ইম্প্রোভাইসেশন তো দরকার। ছেলেমেয়েরা এমনিতেই তো বই পড়ে না। বেশ...... আর দ্বিতীয় কারণটা?'
''আপনার গল্প গুলোতে আপনি বেশ অনেক রিসেন্ট কনসেপ্ট ঢুকিয়েছেন যেমন ধরুন ওই সাইবার ক্রাইম, বেটিং, মুম্বাইয়ের আন্ডার ওয়ার্ল্ড, সাটেলাইট হ্যাকিং ইত্যাদি। মানে ওই নীলকণ্ঠ মণি, রানির জড়োয়া হার বা সোনার গণেশ এই সব থেকে আপনার কনসেপ্ট বেশ আধুনিক - সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু আপনার চরিত্র গুলো অনেক ক্ষেত্রেই আগে পড়া অনেক ক্রাইম থ্রিলারের চরিত্রর সাথে প্রচুর মিল। যেমন ধরুন 'ওই সাত্যকির যিনি বস...। তিনি তো পুরোমাত্রায় হেমেন মজুমদারের 'সুন্দরবাবু' --- সেই একই রকম খাই খাই বাতিক, টেনশন গ্রস্ত , মোটা ভুঁড়িওয়ালা......। কিমবা ধরুন আপনার ভিলেন মিঃ যোগী যার একটা চোখ পাথরের...তিনি তো সুনীল বাবুর 'আগুণ পাখির রহস্য' গল্পের টোবি দত্ত আর ��র্নেল সমর চৌধুরীর মিশেল। আর আপনার যে গল্পের নামটা ভুলে গেছি সেখানে যতদূর মনে পড়ছে একটা চরিত্র যে একজন রিটায়ার্ড কর্নেল, যিনি সাত্যকির ফ্রেন্ড, ফিলোসাফর এন্ড গাইড ---- কি বলব তাকে 'বিমল বাবুর কিকিরা', নাকি কোণাণ ডোয়েলের 'মাইক্রফট' নাকি 'সত্যজিৎ রায়ের সিধুজ্যাঠা'? --- এক দমে কথা গুলো বলে হাঁপাচ্ছিল সোপান। চেয়ে দেখে ভদ্রলোকের ঠোঁটে মুচকি হাসি।
চা এর ভাঁড়টা জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে, সোপানকে কিছুটা চমকে দিয়েই চক্রবর্তীবাবু বললেন -- "তোমার এই বক্ত্যবের সাথে আমি অনেকটার একমত। সত্যি বলতে আমার লেখা আমার নিজেরই পড়তে ইচ্ছে করে না। প্রথম প্রথম লিখে যে তৃপ্তিটা হতো সেটা বহুকাল যাবত পাইনা। তবে একটা নাম তো হয়েছে তার সাথে বেড়েছে প্রত্যাশা। প্রত্যেক গল্পে নতুন কিছু চাই...... সম্পাদক থেকে পাঠক সবার একই চাহিদা। এতো নতুন কোত্থেকে পাই বল তো? একটা গল্পের পেছনে যে আরও কতগুলো গল্প থাকে সেকথা কোনদিন ভেবে দেখেছ কি? এইটে শুধু জেনে রাখো যে ক্রাইম থ্রিলার আমার প্রিয়তম বিষয় নয়।'
মানে ? ---- কথা আটকে গেল সোপানের। লোকটা বলে কি???
'মানেটা বুঝতে গেলে যে তোমাকে আরও কয়েকটা জিনিস বুঝতে হবে। দেখো... আমার যখন তোমার মতো বয়স......মানে এই ধর ২৫-২৬...... '
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো সোপান।
'তখন আমার বাবার জোরাজুরিতে একটা দপ্তরীর অফিসে কাজ নিই...... উড়িষ্যাতে। ইচ্ছে না থাকলেও নিতে হয় চাকরিটা... বাড়ির অবস্থার কথা ভেবে। বাবা রিটায়ার করেছেন। মা র হার্টের রোগ ধরা পড়েছে। তবে বছর খানেক চাকরি করে কলকাতায় ফিরে আসি। আসানসোলে একটা স্কুলে লাইব্রেরিয়ান এর কাজ পাই। কাজ না হাতি...... । সেখানে সারাদিন বসে থাকাটাই যে কাজ। কিছুটা সময় কাটাতেই শুরু করি 'বই পড়া' । শরৎচন্দ্র বা বঙ্কিমি রচনা না পড়লেও বাকি যা পেয়েছি --- সব পড়তে শুরু করলাম। শরদিন্দু, সুনীল, দুই সমরেশ, বিমল কর, আশাপূর্ণা দেবী, হেমেন রায়, মুস্তাফা সিরাজ, সঞ্জীব, শিবরাম থেকে শুরু করে ইন্দ্রজাল কমিক্স, টিনটিন, আস্টেরিক্স, বাঁটুল, নন্টে-ফন্টে.........আর কত বলব। পড়তে পড়তে শখ হয় লেখার..... তখন আমার বয়স প্রায় তিরিশের দোরগোড়ায়। টুকটাক লিখতে শুরু করি ...। মাস ছয়েকের মধ্যে একটি লেখা একটি মাসিক পত্রিকায় ছাপে...... ফলস্বরূপ আমার লেখার উৎসাহ বেড়ে তিনগুণ...।' চক্রবর্তীবাবু বেশ উত্তেজিত।
'ব্যস...... তারপর তো ভিনি ভিডি ভিসি' -- ফুট কাটল সোপান।
'অ্যাঁ...' ভদ্রলোক যেন একটু আনমনা। খেই হারিয়ে বসে রইলেন কয়েক সেকেন্ড। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন -- 'না সোপান বাবু ব্যপারটা অতটাও সোজা ছিল না কারণ আমি তো আর জুলিয়াস সিজার নই।'
আব��র কয়েক সেকেন্ড বিরতি নিয়ে বলা শুরু করলেন -- 'থাকতুম আসানসোলে। আসানসোল থেকে কলেজ স্ট্রীট করতে করতে জুতোর সুকতলা খুইয়েছি প্রায় বছর দুয়েক। মাথায় তখন পোকা এমন নড়েছে যে লাইব্রেরিয়ানের চাকরিটা অবধি ছেড়ে দিই। কলকাতায় এসে একটা প্রিন্টিং প্রেসে কাজ নিই আর সম্পাদকদের অফিসে ধাওয়া করি...এমন ভাবে চলল বছর তিনেক। টুকটাক এদিক ওদিক লেখা ছাপলেও ঠিক মনের মতো কিছু হচ্ছিল না। শেষমেশ এক প্রেসের মালিককে ধরি। কথা হয় যে উনি আমার লেখা আটটি গল্প ছাপবেন। ছাপানোর খরচ আমাকে দিতে হবে তবে লভ্যাংশের একটা মোটা পরিমাণ প্রেস মালিক নেবেন। মানে সব মিলিয়ে আমার 'হাতে রইলো পেনসিল' গোছের চুক্তি। ছাপানোর খরচ তখনকার দিনে তা প্রায় হাজার বারো। আমার মাথায় তখন এমন রোখ চেপেছে যে চড়া সুদে টাকা ধার করি বড়বাজারের এক মহাজনের থেকে। এখনও মনে আছে দিনটা...... ১৮ই জুন ১৯৯৪... টাকাটা প্রেস মালিকের হাতে তুলে দিয়ে এসে টেনশনে ডালহৌসি অবধি হেঁটে গিয়ে লালদিঘির পাড়ে টানা ঘণ্টা পাঁচেক বসেছিলাম। বইটা ছেপে বেরোয় সেই বছর মহালয়ার দিন। বইটার নাম দিয়েছিলাম - 'দুই তারার ঝিকিমিকি'। সে বছর ওই পুজো থেকে বইমেলা অবধি নিজে হাতে সেই বই নিয়ে ঘুরেছি কলেজ স্ট্রীটের এ দোকান থেকে সে দোকান, শিয়ালদহের খবরের কাগজের দোকান গুলোতে, বইমেলাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেছি। -- একটু থামলেন চক্রবর্তীবাবু।
ট্রেনটা একটা ওভার ব্রিজের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। সোপানের কাছে গল্পটা যেন হটাৎ করেই খুব চেনা হয়ে উঠেছে আর ট্রেনের ঘটাং ঘটাং আওয়াজটা যেন একটু বেশিই কানে লাগছে। বোতল থেকে দু ঢোক জল খেয়ে আবার বলতে লাগলেন চক্রবর্তীবাবু। ট্রেন ততক্ষণে ফিরে এসেছে স্বাভাবিক ছন্দে।
'তখন ওই বইটা আর আমার শখের সাহিত্য চর্চা নয়...। বলতে পারো আমার বেঁচে থাকার শেষ সম্বল। মোট ৩৩ টা কপি বিক্রি হয়েছিল। সব মিলিয়ে প্রায় হাজার আটেক টাকার লোকসান আর মাথার ওপর মহাজনি দেনার দায়। প্রেসের কাজের মাসমাইনে দিয়ে যা শোধ করা যাকে বলে অসম্ভব। জীবনের গতি তখন প্রায় থেমে যায় আর কি। এভাবে মাস দুয়েক কোনক্রমে কাটল। তারপর একদিন ওই প্রেস মালিকের কাছে আমার একটা ফোন আসে। একজন সাংবাদিক একটা খবরের কাগজের রোববারের কলামের জন্য আমার একটা লেখা চাইছেন - শর্ত একটাই --- ক্রাইম থ্রিলার লিখতে হবে--- কারণ ওটার কাটতি আছে। হাতে সময় বড়জোর দু সপ্তাহ। লিখলাম, জমা দিলাম, লেখা ছাপলও ----- এবং হ্যাঁ তারপর তোমার ওই ভিনি --- ভিডি --- ভিসি। আমি হয়ে গেলাম ক্রাইম থ্রিলার লেখক .........।' শেষের কথাগুলো কেটে কেটে বলে থামলেন ভদ্রলোক।
থামার অবিশ্যি আর একটা কারণ আছে। দুপুরের খাবারের অর্ডার নিতে এসেছে। দু জনের জন্য দুটো ডিম-কারী মিল বলে দিলেন চক্রবর্তীবাবু। সোপান শুধু ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিল... মুখে কিছু বলল না। তার চোখে তখন 'বসন্ত গলি ঘুরছে'।
'আসলে তুমি ঠিক-ই বলেছ। লিখে আনন্দ পেতাম প্রথম দিকে। নিজের মতো লিখতাম --- নিজের ভালো লাগার জন্য লিখতাম। সাত্যকি বোস তখন ছিল না। একটা দুটো বইয়ের কাটতি একটু কম হতেই সম্পাদক মশাইয়ের অনুরোধ এলো 'একটা চরিত্র তৈরি করার'। বাঙ্গালী নায়ক চায়...। চরিত্র চায়...। ঘনাদা, টেনিদা, কিকিরা, ব্যোমকেশ, ফেলুদা, অর্জুন কিমবা গোগোল --- এই নিয়ে বাঙ্গালী আর কতদিন থাকবে। নতুন কিছু চাই...। লালমোহনের ভাষায় যাকে বলে 'হাই ভোল্টেজ স্পার্ক.' ........ হা হা!। সেই তাড়নায় জন্ম হল 'সাত্যকি বোস -এর '...... আর যে রং চড়ানো ইমেজের কথা তুমি বলছ তা আমারই সৃষ্টি...... তবে কতটা সদিচ্ছায় আর কতটা প্রয়োজনে সেটা আমি নিজেও জানিনা। নিজের মতো যে লেখার চেষ্টা করিনা তা নয়, তবে সেগুলো ছাপাই না। ইচ্ছে আছে কোনও একদিন আবার এক প্রেস মালিককে ধরে লেখাগুলো ছাপাবো। কি বুঝলে?' --- চোখ নাচিয়ে ঠোঁটের কোণে একটা হালকা হাসি নিয়ে বললেন ভদ্রলোক।
দুপুরে খেতে খেতে টুকটাক কথার বেশী কোনও আলোচনাই বেশিক্ষণ গড়ায় নি। আসলে সোপানের কথা বলার ইচ্ছেটাই চলে গেছিল। সাফল্যের শীর্ষে থাকা একজন মানুষের থেকে এত সহজ স্বীকারোক্তি পাওয়ার পর আর কি-ই বা বলার থাকতে পারে। কেন জানেনা তবে চক্রবর্তীবাবুর সাথে এই কথোপকথনের পর মনের ভেতরের দমবন্ধ ভাবটা অনেকটাই হালকা লাগছিল সোপানের। দুপুরে খাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ ট্রেনের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চুপ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল সোপান - 'সাফল্য তাহলে কি? পরিশ্রম নাকি আপোষ নাকি চান্স ফ্যাক্টর...... নাকি পুরো ব্যাপারটাই একটা মিথ'। হঠাৎই মনে হল...... ট্রেনটাই তখন যে শুধু চলছে ---- আর কিছুই যে আর পিছিয়ে যাচ্ছে না ---- না রেল লাইনগুলো --- না দূরের গাছগুলো। 'তাহলে পুরোটাই কি দেখার ভুল নাকি ভাবার?' আনমনেই একটা সিগারেট ধরাল সোপান।
সন্ধ্যে বেলায় লখনউ স্টেশনে চক্রবর্তীবাবু নেমে যাওয়ার আগে সোপানের ঠিকানাটা নিয়ে বললেন -- 'ঠিকানাটা নিয়ে রাখি। যদি নিজের কোনও লেখা নিজের ভালো লাগে তবেই পাঠাব।' সোপান একটা অটোগ্রাফ চাইতে উনি মুচকি হেসে বললেন 'অটোগ্রাফ তো আমি দিই না ভাই'। তারপরেই কয়েক সেকেন্ড কি যেন ভেবে নিজের নোটবুকে খস খস করে লিখে, কাগজটা ছিঁড়ে সোপানের হাতে দিলেন। তারপর 'আবার দেখা হবে' বলে হাত নেড়ে নেমে গেলেন। কাগজটাতে নীল কালি দিয়ে লেখা ছিল - 'When you have eliminated the impossible, whatever remains, however improbable, must be the truth!' উক্তিটা সোপানের চেনা...... হোমসের উক্তি---- দ্য সাইন অ�� ফোর গল্প থেকে। আজ একটু অন্যরকম লাগলো। দুম করে ভদ্রলোক কথাটা কেন লিখলেন সেটা ধোঁয়াশাই থেকে গেল সোপানের কাছে। কাগজটা হাতে নিয়েই বসে ছিল সোপান অনেকক্ষণ - গতকাল থেকে হওয়া ঘটনা গুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথায়। হঠাৎই মাথায় এলো রাতের স্বপ্নটার কথা----বসন্ত গলির কথা---- অনিন্দ্যর কথা। নাহ... বিরক্তিটা আর সেই রকম হচ্ছে না সোপানের। বরং ফেসবুক খুলে অনিন্দ্য-র পোস্টে হালকা আঙ্গুলের চাপে লাইকের সংখ্যা আর একটা বাড়াল সোপান। কমেন্টে একটা ছোট্ট স্মাইলি সহ লিখল শুধু একটা শব্দ - 'সা-বাঁশ'। দু মিনিটের মধ্যে উত্তরও এসে গেল - 'ঠিক বলেছিস'। উত্তরটা দেখে মুচকি হাসল সোপান।
লুধিয়ানার চাকরিটা সোপান পেয়েছিল। আসলে চাকরি না পাওয়ার ভয়টাই যে তার আর ছিল না। নিজেকে বুঝিয়েছিল কিছু না হলে 'ওই বসন্ত গলিতে প্লাস্টিক বিছিয়ে পুরনো বইয়ের দোকান দেবে'। নিজের ভাবনাতে নিজেই হেসে ফেলেছিল সোপান। তারপর কলকাতায় ফিরে গোছগাছ করে আবার লুধিয়ানা। তবে খুব তাড়াহুড়োর মধ্যেও লুধিয়ানা যাওয়ার আগে পথিকৃৎ চক্রবর্তীর না পড়া দুটো বই কিনেছিল সোপান......... হ্যাঁ 'বসন্ত গলির' ওই মেডিক্যাল কলেজের উলটোদিকের ফুটপাথ থেকেই।
************
আজ প্রায় সাড়ে চার মাস বাদে পুজোর ছুটিতে সোপান ফিরেছে কলকাতায়। ফিরেই হাতে পেল খামটা। মাস তিনেক আগেই খামটা এসেছে, প্রেরকের নাম - সুজিত চক্রবর্তী, আসানসোল। নামটা পড়েই এক ঝটকায় অনেক কিছু মনে পড়ে গেল সোপানের। খামটা ছিঁড়তেই বেরোল রুল টানা কাগজে লেখা একটা বড় চিঠি।
প্রিয় সোপান,
আশাকরি আমাকে তোমার মনে আছে। কতকগুলো কথা বলার ছিল বলেই ঠিকানাটা নিয়েছিলাম।
অনেকদিন পর (নাকি প্রথমবার) এমন একজনের সাথে আমার আলাপ হল যাকে আমার কৈশোর সংস্করণ বলতে পারি নির্দ্বিধায়। তোমার বয়সে আমিও ছিলাম এক বইপোকা। অন্যেরা যে সময়ে ঘুড়ি ওড়াত, ডাংগুলি খেলত, ফুটবল খেলত --- আমি সে সময়ে পড়ে থাকতুম আমাদের গ্রামের লাইব্রেরিতে। যা পেতুম --- পড়তাম। বাবার ঠ্যাঙ্গানি, স্কুলের বলাইবাবুর বেত কিছুই আটকাতে পারেনি আমাকে। সেদিন ট্রেনে যখন তুমি বাংলা ক্রাইম থ্রিলার নিয়ে উত্তেজিত ভাবে কথা বলছিলে --- আমি হাতড়ে বেড়াচ্ছিলাম নিজেকে ...... তোমার মধ্যে। সেদিন ভোর রাতে তুমি ঘুমিয়ে পড়ার পরও আমি জেগেছিলাম। তন্দ্রাটা ভেঙ্গেছিল তোমার গোঙানিতে। মনে হয় তুমি কোনও স্বপ্ন দেখছিলে...আর ঘুমের মধ্যে বিড় বিড় করছিলে 'আমাকে ছেড়ে দাও ...... চাকরিটা আমায় পেতেই হবে...... আমি চাকরি করব......এই রকম কিছু।' তোমাকে ডাকার চেষ্টা করিনি। তোমার বয়স, তোমার পাঞ্জাব যাওয়ার সিদ্ধান্ত আর তোমার সাময়িক উত্তেজনা দেখে- অনুমান করেছিলাম তোমার মনের মধ্যের ঝড়টার কথা। কলকাতায় যে তোমার কোনও চাকরি কল ছিল না সেটা আমার অন্তত না বোঝার কোনও কারণ ছিল না। বছর পঁচিশ আগে এইরকমই একটা ঝড় যে আমার জীবনেও এসেছিল...। তাই তোমার মানসিক অবস্থাটা বুঝতে পারলেও কিভাবে তোমাকে সাহায্য করা যায় বুঝতে পারছিলাম না। উপায়টা তুমি-ই বাতলালে পথিকৃৎ চক্রবর্তীর নাম করে।
এক্ষেত্রে জানিয়ে রাখা ভালো যে আমার নাম সুজিত চক্রবর্তী...... আর আমি সাহিত্যিকার পথিকৃৎ চক্রবর্তী নই। তিনকুলে আমার সাথে ওনার কোনও সম্পর্কও নেই। আমি আসানসোলের তিমিরবরণ উচ্চ বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান। পথিকৃৎ চক্রবর্তীর বেশ কিছু বই আমার পড়া। আর তোমার কথাতেই কিছুদিন আগে ওনার ওপর আনন্দবাজারের লেখাটার কথাটা মনে পড়ে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি যে আমি নিজে অল্প স্বল্প নাটক করি, স্ক্রিপ্টও লিখি। তাই বাকিটা গুছিয়ে ফেলতে আমার খুব বেশী সময় লাগেনি। যাইহোক তুমি মাত্র তিনটে বই পড়েছ শুনে আশ্বস্ত হয়েছিলাম......না হলে ধরা পরে যেতুম বইকি। ভাগ্য ভালো যে ওই বইগুলি আমারও পড়া ছিল। যাইহোক তোমাকে পরদিন সকালে যে গল্পটা বলেছিলাম তার পুরোটা কিন্তু বানানো নয় -- অনেকটাই আমার নিজের জীবন থেকেই নেওয়া। আমি নিজে লেখক হত্যে চেয়েছিলাম...... আসানসোল থেকে কলেজ স্ট্রীট আমিই জুতোর সুকতলা খুইয়েছি প্রায় বছর দুয়েক। আমিই সেই অধম যে চাকরি ছেড়ে লেখক হত্যে চেয়েছিল এবং এক প্রেস মালিকের কাছে চুক্তিও করে এসেছিল নিজের বই 'দুই তারার ঝিকিমিকি' ছাপানোর জন্য --- বারো হাজার টাকার বিনিময়ে। কিন্তু শেষমেশ আমি পারিনি......... ওই টাকা আমি জোগাড় করতে......। আর সুদে টাকা ধার করার সাহসও আমার ছিল না। আপস করে নিয়েছিলাম নিজের ইচ্ছের সাথে। ফিরে এসেছিলাম আসানসোল...... দিনটা মনে আছে ১৮ই জুন ১৯৯৪। তৎকালীন হেডমাস্টারমশাই-এর বদান্যতায় চাকরিটা ফিরে পাই। বাকিটা বানিয়েছি -- কিছুটা কল্পনা আর কিছুটা আমার 'আপসবিহীন স্বপ্ন' গুলো থেকে। আসলে প্রায় সব সফল মানুষদের জীবনে হয়ত এ রকম একটা অধ্যায় থাকেই -- 'There is nothing new under the sun. It has all been done before' -- আবার কোনান ডয়েল ঝাড়লাম। বলতে বাধা নেই যে 'আমি ভিতু',... একটু সাহস করলে...... হয়ত.........। বলছি না 'পথিকৃৎ চক্রবর্তী' হতাম কিন্তু জীবনে আপসোসটা একটু কম থাকতো। পরে অনেক ভেবেছি...... একজন যদি কেউ পাশে থেকে.........। বলতে পারো......সেই সাহসটাই একটু দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম তোমাকে...... কিছুটা অযাচিত ভাবেই... যেটা 'সুজিত চক্রবর্তী' হয়ে সম্ভব ছিল না......তাই পথিকৃৎ চক্রবর্তীর সাহায্য নিয়েছিলাম। থ্যাংকস টু মাই পেরেন্টাল পদবি.........হা হা!
অবশ্য কতটা সফল হয়েছিলাম জানিনা......এমনও হত্যে পারে যে তোমাকে নিয়ে আমার পুরো অনুমানটাই মিথ্যে। সেক্ষেত্রে আমাদের আলাপটাকে 'রেল কোম্পানির টাইম পাস' বলে ভুলে যেও। তবে তোমার কল্যাণে আমিও যে কয়েক ঘণ্টার জন্য একজন খ্যাতনামা সাহিত্যিক হলাম সেটাই বা কম কি। তবে একটা কথা- তোমাকে যতটুকু দেখলাম তাতে এটুকু বলতে পারি 'তোমার সফল হওয়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা'। 'হাল ছেড়োনা বন্ধু' আর ওই ছেঁড়া কাগজের হোমসবাবুর কথাটা মনে রেখো.........কাজে দেবে। আর যদি সফল নাও হও...... কি যায় আসে...। দেখলে তো একজন ভিতু - অসফল মানুষকে...। মানুষের মতোই তো দেখতে না কি ...... হা হা।
আশাকরি কিছু মনে করোনি। জানিনা যে তুমি এখন লুধিয়ানা-তে না কলকাতায়। তবে যেদিনই চিঠিটা পাবে----- পারলে একটা উত্তর দিও। আমার ঠিকানা দেওয়া আছে নিচে।
শেষে একটা কথাই বলি -- আমার 'দুই তারার ঝিকিমিকি' বইটার ম্যানুস্ক্রিপ্ট টা এখনও আমার কাছে আছে। যদি কোনদিন ছাপতে পারি তোমায় একটা কপি পাঠাব...... ।
ভালো থেকো।
শুভেচ্ছান্তে
সুজিত চক্রবর্তী।
0 notes
Text
দূরভাষ
সৃষ্টির একুশ শতক পত্রিকায় ফেব্রুয়ারী ২০১৮ তে প্রকাশিত
ডঃ অনিকেত সেন। উনপঞ্চাশ বছর আগে মালদা জেলার ছোট্ট একটি গ্রাম থেকে যাত্রা শুরু করে আপাতত তিনি হাওড়া স্টেশনের Enquiry বুথের সামনে। সময় কিভাবে নষ্ট করতে হয়...Biochemist ডঃ অনিকেত সেনের জানা নেই। আর এখন তাকে ঝারা এক ঘণ্টা কিছু না করে সময় নষ্ট করতে হবে। খুবই বিরক্তির সাথে হাতঘড়ি টার দিকে তাকিয়ে দেখল অনিকেত। প্রায় সাড়ে পাঁচটা। সন্ধ্যে নয় -- সকাল।
ডঃ মিতালি চ্য��টার্জি। আটচল্লিশ বছর আগে নাকতলা থেকে যাত্রা শুরু করে আপাতত সরাইঘাট এক্সপ্রেসের বি২ কোচের যাত্রী। বাথরুম থেকে চোখে মুখে জল দিয়ে এসে ব্যাগ খুলে মোবাইলটা বার করে অনিকেতের নম্বরটায় এই নিয়ে তৃতীয় বার চেষ্টা করলেন। রসায়নের প্রফেসর বলেই হয়ত মিতালির একটা অনুসন্ধিৎসু মন আছে এবং তার প্রিয়তম বিষয় হল 'মানুষ'। তবে আপাতত সেই মন কে বিশ্রামে রেখে অনিকেতের স্ত্রী মিতালি মন দিল হেমেন্দ্র কুমার রায়ের এক গোয়েন্দা উপন্যাসে। ওদিকে ভোরের আলো ফুটল বলে...।
সৃজন সেন। বছর ষোল আগে আমেরিকার নিউ হাভেন শহর থেকে যাত্রা শুরু করে আপাতত দিল্লি শহরে নিজের ঘরে তৃতীয় বার Skyfall সিনেমাটা দেখে ল্যাপটপটা বন্ধ করল। ওর রুমমেট সাহিল তখনও ল্যাপটপে ঘাড় গুঁজে কলেজের প্রোজেক্টের কাজে ব্যাস্ত। প্রোজেক্ট মানেজ করা ব্যাপারটা মিতালি-অনিকেতের একমাত্র পুত্র সৃজন ভালোই পারে -- সেটা তার অভিনয়ের গুনেই হোক আর গুছিয়ে কথা বলতে পারার জন্যেই হোক। তাই সাহিল্ কে Good Morning বলে ঘুমোতে গেল সৃজন।
************** হাওড়া স্টেশন থেকে বেরিয়ে পড়লেন অনিকেত। মিতালি কে একবার ফোন করার চেষ্টা করলেন কিন্তু পেলেন না। আজ মিতালি মাস ছয়েক বাদে কলকাতায় আসছে। গেলবার এসেছিল সেই মে মাসে ওদের semester ব্রেক ছিল তখন। অবশ্য অনিকেত তখন আবার ব্যাস্ত ছিলেন একটা সেমিনার নিয়ে। এবারে আশা করা যায় সেরকম কোনও ব্যাস্ততা নেই। তবে বেসরকারি চাকুরেদের জীবন ... কিছুই বলা যায় না। অবশ্য সময় দিতে না পারার জন্য মিতালি কিছুই বলে নি। বন্ধু বান্ধব, ওর মামার বাড়ি নিয়ে দিব্যি সপ্তাহ খানেক কাটিয়ে ফিরে গেছিল গৌহাটি। কোনও ফালতু অভিমানে মিতালি নেই --- সেটা অনিকেত ভালোই জানেন। বরং যাওয়ার আগের দিন অনিকেতের সাথে বসে বেড়ানোর প্ল্যান ও করেছিল - প্রথমে দিল্লি --- তারপর সেখান থেকে সৃজন কে নিয়ে কিন্নর কল্পা। দিন ছয়েকের প্ল্যান ...। এই আগামীকাল বেরনোর কথা ছিল। সেই জন্যেই এবার মিতালির আসা।
তবে সে প্ল্যান হচ্ছে না। গত কাল দুপুরে সৃজন জানায় ওর হবে না, কলেজে প্রোজেক্ট আছে এবং তারপর কিছু assignment। এদিকে প্রায় সব ব্যাবস্থা পাকা--- ফ্লাইটের টিকিট, হোটেল সব ক্যান্সেল করেছেন অনিকেত। মিতালিকে যখন জানান অনিকেত তখন ও ট্রেনে। বোঝা গেল মুষড়ে পরেছে...... তবে অনিকেত জানেন মিতালি কলকাতায় এলে সব ভুলে দিব্যি এক সপ্তাহ কাটিয়ে ফেলবে। মুস্কিল তা হচ্ছে অনিকেতের নিজের। ডঃ সেন যে আগামী কয়েকদিন নেই সেটা প্রায় সকলেই জানে। ম্যানেজমেন্ট প্রথমে ছুটি দেয় নি শেষে ছেলের অসুস্থতার কথা বলার পর ছুটি মঞ্জুর হয়। অনিকেত নিজে যে নিজে বেড়াতে যেতে খুব একটা চেয়েছিলেন তা নয়........ তবে কিছুটা সৃজনের জন্যই...। দূরে থাকলেও ছেলেকে বড্ড ভালবাসেন অনিকেত। ম্যানেজমেন্টকে এখন কি বলবেন সে তা ঠিক ভেবে উঠতে পারেননি অনিকেত।
আপাতত অনিকেত গঙ্গার ধারে...... হাওড়া ব্রিজের আলো গুলো এখনও নেভেনি। ছবি তোলার একটা নেশা এককালে অনিকেতের ছিল...। ধর্মতলার ক্যামেরার দোকান গুলোতে নিয়মিত যাতায়াতও ছিল তার। তবে শেষ কবে ছবি তুলেছেন মনে করতে পারলেন না। ঘড়ির কাঁটা ধরে দিন চলে অনিকেতের ---- সকাল থেকে রাত ---- আবার রাত থেকে সকাল --- বিরামহীন। গতকালও অফিস থেকে যখন বাড়ি ঢোকেন তখন রাত ৮ টা। মোবাইল দেখার সময় কোথায়? টুং করে একটা মেসেজের আওয়াজে সম্বিত ফিরল অনিকেতের। মোবাইলটা বুক পকেট থেকে বার করলেন। কোনও এক শপিং মলে ৪০% ছাড় দিচ্ছে। বিরক্তিটা বেড়ে গেল অনিকেতের। মোবাইলটা বন্ধ করতে যাওয়ার সময় মেসেজ বক্সের তিন নম্বর মেসেজ তার দিকে চোখ গেল অনিকেতের। একটা অচেনা নম্বর। ইংরেজি অক্ষরে কেবল একটা লাইন লেখা ---- 'তোকে কি আমি একটা ফোন করতে পারি?' তলায় লেখা ---- 'বাবলূ'। ক এক সেকেন্ড মেসেজটার দিকে চেয়ে রইলেন অনিকেত ----- বা বলা ভালো ওই 'বাবলূ' শব্দটার দিকে। 'বাবলূ' নামে কাউকে চেনেন অনিকেত? একবার মনে পড়ল ওনার অফিসের তলার চা এর দোকানের ছেলেটার নাম মনেহয় 'বাবলূ'। কিন্তু সে অনিকেতকে এই ভাবে মেসেজ করবে কেন? আর একবার মেসেজটা দেখলেন অনিকেত। মেসেজটা এসেছে গতকাল রাত ১১.২৩ এ। মানে তখন অনিকেত ঘুমিয়ে পরেছিলেন। 'বাবলূ'...... 'বাবলূ'...... নামটা মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল অনিকেতের। এমন কোন 'বাবলূ' আছে যে তাকে 'তুই' বলতে পারে? 'তুই' বন্ধু দের সঙ্গে তো কবেই যোগাযোগ শেষ হয়ে গেছে ---- দু একজন আছে তবে তারা সবাই বিলেতে। এবং তাদের নাম 'বাবলূ' নয়। হঠাৎ মনে হলে বেকার এত ভাবছেন একটা ফোন করলেই হয়। সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই বোতামে চাপ দিলেন। বেশ কয়েকবার রিং হয়ে গেল --- কিন্তু ফোন টা কেউ ধরল না। মরিয়া ভাবে আর একবার করলেন কিন্তু এবারেও একই ফল। দমে গেলেন অনিকেত। মেসেজের রিপ্লাই দিলেন 'Do I know you?'
************** স্নান সেরে মিতালি যখন বেরল তখন ঘড়িতে ৯:২০। অনিকেত তখন খবরের কাগজের পাতা ওলটাচ্ছে। আজ রবিবার -- তাই অফিস ছুটি।
মিতালি- 'সৃজন আর ফোন করেনি তোমাকে?' অনিকেত- 'নাহ। গতকাল দুপুরবেলাতে ফোন করে খবর টা দিল।। তারপর তো আর করে নি।' মিতালি- 'সব Cancel করে দিয়েছ?' অনিকেত- 'হ্যাঁ...। সেসব হয়ে গেছে। গত কাল সন্ধ্যে বেলাতে ফিরে করলাম' মিতালি- 'কলেজগুলোর একটা Academic Plan থাকা উচিত। এই ভাবে কেউ project submission এর ডেট দেয়?'
মিতালির খারাপ লাগাটা অনিকেত বোঝে। চিরকালই মিতালি বেড়াতে ভালবাসে। অবশ্য সেটা অনিকেতও ভালবাসেন......তবে ইদানীং সৃজনের পড়াশুনো আর নিজেদের কাজের চাপে বছর দুয়েক বেড়াতে যাওয়া হয়নি। পোস্ট গ্রাজুয়েশন পাশ করে অনিকেত আমেরিকায় যান পি এইচ ডি করতে তখন সালটা ১৯৯৫। মিতালির সাথে আলাপ ওখানেই। মিতালিও তখন পি এইচ ডি করছে। নিউ ইয়র্ক শহরের এক বাস স্ট্যান্ড থেকে দুজনের পরিচয়......সেই থেকে প্রেম। তারপর ১৯৯৮ এ দেশে ফিরে বিয়ে এবং আবার আমেরিকা গমন। এবারে নিউ হাভেন শহরে। সৃজনের জন্ম ওখানেই।
অনিকেত- 'সে আর কি করা যাবে? টা তুমি কি Depressed হয়ে পরলে নাকি? মিতালি মুচকি হেসে বলল--- ' সে আমি না তুমি...? সামনের সাতদিন ছুটি নিয়ে বসে আছ। ছেলের শরীর খারাপ কোন জাদুবলে সেরে গেল...... কি বলবে অফিসে?' অনিকেত- 'সেটাই তো ভাবছি'।
মিতালি জানে অনিকেত নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ। ওর ছুটি নিয়ে অফিসে কোনরকম কুটকাচালি ও চায় না। এদিকে বাড়িতে বসে থাকার লোক ও নয়। মিতালি এক্কেবারে উল্টো। কে কি ভাববে সেই নিয়ে মিতালি কোনদিনই বিশেষ ভাবে নি। তাই ছোট্ট সৃজন কে বাপের বাড়িতে রেখে উড়িষ্যার প্রথম চাকরিটাতে জয়েন করার সিধান্ত নিতে মিতালির সময় লেগেছিল বড়জোর দশ মিনিট। আমেরিকা থেকে ফেরার পর বছর পাঁচেক মিতালি কোনও অ্যাপ্লাই করেনি। তারপর করেছে এবং চিন্তা ভাবনা করেই করেছে। ছোট থেকে সৃজনকেও তৈরি করেছে সেই ভাবেই। পরিষ্কার ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে সবকিছু......... প্রত্যেকের জীবনের মূল্যবোধ। অনিকেতও সেটাকে মর্যাদা দিয়েছে...... তবে ছেলের ব্যাপারে অনিকেত একটু বেশিই আতুকে। সৃজনকে দিল্লি পাঠানোর সিধান্তটা পুরোপুরি মিতালির......অনিকেত তাতে সায় দিয়েছে মাত্র। কিন্তু মিতালি জানে যে ছেলেকে কাছে রাখতে পারলেই অনিকেত খুশি হত বেশি। ছেলের প্রতি মিতালির কোনও extra ন্যাকামি নেই। লুচি তরকারির প্লেট অনিকেতকে দিয়ে নিজে নিয়ে বসল মিতালি। মোবাইল হাতে নিয়ে সৃজনকে ফোন করল। টুকটাক কথা বলে ফোনটা অনিকেতকে চালান করে দিয়ে আবার লুচি তরকারিতে মন দিল। মিনিট দশেক বাদে অনিকেত প্লেট রাখতে এসে মিতালিকে বলল "তোমার ছেলে এখন সরেস হয়েছে। বলে কিনা যাও 2nd Honeymoon তা সেরে ফেল। ছুটিটা ক্যানসেল কোর না।"
************** মেসেজটা এলো তার একটু পরে। মেসেজটার কথা বেমালুম ভুলে গেছিলেন অনিকেত। এবারেরটা আগেরবারের মতই - "Sorry ঘুমচ্ছিলাম। তাই তোর ফোন ধরতে পারিনি। Free থাকলে জানাস।" সকালের সেই অস্বস্তি টা ফিরে এলো অনিকেতের। মরিয়া হয়ে বোতাম টিপলেন ---- ওপাশে রিং হচ্ছে। যে গলাটা শুনলেন সেটা খ্যানখেনে...এক বয়স্ক লোকের।
অনিকেত প্রথমেই বললেন 'আমি কি আপনাকে চিনি?'
ক এক সেকেন্ড চুপ থাকার পর্ব ওপাশের গলা উত্তর দিল "গোপালচন্দ্র মেমোরিয়াল বিদ্যাপীঠ মনে আছে?"
গোপালচন্দ্র মেমোরিয়াল বিদ্যাপীঠ মানে অনিকেতের ছোটবেলার স্কুল যেখানে উনি মাধ্যমিক অবধি পড়েছেন। অনিকেত উত্তর দিলেন " হ্যাঁ... কিন্তু আপনাকে তো ঠিক..."
ফোনের ওপার কণ্ঠ উত্তর দিল "আর... বাবলু কে ভুলে গেলি"।
অনিকেত খুব কষ্ট করেও কোনও বাবলুকে মনে করতে পারলেন না। বললেন " না ঠিক মনে পরছে না...।"
খ্যানখেনে গলায় হাল্কা একটা হাসি শুনলেন অনিকেত। তারপর শুনলেন "আচ্ছা 'লোথার' কেও ভুলে গেলি তুই?"
বিদ্যুৎ গতিতে অনেককিছু মনে পরে গেল অনিকেতের। লোথার, মানড্রেক, বাহাদুর আর বেতাল --- এই চারজনের মধ্যে অনিকেত ছিলেন 'বাহাদুর' আর বাকি ত���নজন মানে বাদল ছিল 'বেতাল', আলম ছিল 'মানড্রেক' আর 'লোথার' ছিল পুলক। ধাঁ করে চারপাশ তা কি রকম এক মুহূর্তে বদলে গেল অনিকেতের। চিৎকার করে বলে উঠলেন "পুলক?" পুলকের ডাকনাম যে বাবলু সেটা মনেই ছিল না।
ওপাশের হাসিটা আর একটু বাড়ল। বলল - " হ্যাঁ রে ব্যাটা...।"
অনিকেত বললেন " তা এত ভণিতা কেন রে। সোজাসুজি ফোনই তো করতে পারতিস। আর কোথায় আছিস?"
পুলক বলল " ভণিতা নয় রে...। তোর সম্বন্ধে কিছু দিন আগেই জানলাম এক জনের থেকে। জানলাম তুই এখন বিশাল ব্যাস্ত। তাই একটু জিগ্যেস করে নিলাম আর কি? অবশ্য তার একটা অন্য কারণও আছে।"
'কি কারণ রে'--অনিকেত শুধল।।
'সে অনেক কথা......আগে বল আছিস কেমন। ওঃ প্রায় বছর পঁয়ত্রিশ বছর পরে কথা হল তোর সাথে।" পুলকের উত্তেজনাটাও টের পাচ্ছিল অনিকেত।
'তুই আছিস কোথায়?' -- অনিকেত জানতে চাইল।
'আমি ভিলাইতে আছি...। নিজের ব্যাবসা...।। আমার দুই মেয়ে আর এক বৌ......। হা হা । তবে আপাতত আমি কলকাতায়।'
'বলিস কি রে ...... কলকাতায়? তা চলে আয় আমার বাড়ি। আড্ডা মারা যাবে।'
'না রে । সেখানেই তো প্রব্লেম। আজ সারা দিন ব্যাস্ত থাকব এই ব্যাবসার কাজে...।। বুঝিসই তো GST-র জমানা। তবে একটা প্ল্যান আছে। সেই জন্যেই তোকে ফোন করছি। "
"প্ল্যান? কি প্ল্যান?"
"বলছি দু তিন দিন ছুটি মানেজ করতে পারবি? এই সামনের বৃহস্পতিবার অবধি।"
কেন বল তো? -- অনিকেতের গলায় প্রশ্ন
"বলছি... হরিসছন্দ্রপুর যাবি? মানড্রেক ও আসবে। দিন দুয়েক কাটিয়ে চলে আসব।"
'মানে? কি বলছিস তুই? মানড্রেক? সে কোথায়?' বিস্ময়ের ঘোর কাটে না অনিকেতের।
'বলব...।সব বলব। যাবি তো? না করিস না।' পুলকের নাছোড় আবদার।
'আর বাদল? আমাদের 'বেতাল বাবু?' অনিকেত শুধলেন তার প্রিয় বন্ধুকে।
'ওহ বাদলের খবরটা জানিস না তুই? " -- পুলক একটু বিচলিত।
'না। আমি কিছু জানি না। কেন কি হয়েছে বাদলের?' অনিকেত উতলা।
'বাদল বাঙ্গালোরে ছিল রে। বছর চারেক আগে এক Road এক্সিডেন্টে----- "
'কি.................." চিৎকার করে উঠলেন অনিকেত। মিতালিও ছুটে এসেছে। এসে দেখে অনিকেত ফোন হাতে থর থর করে কাঁপছেন। চোখের ইশারায় জিগ্যেস করল মিতালি। অনিকেত মিতালিকে হাত নেড়ে এক গ্লাস জল দিতে বললেন।
'তাই তো বলছি রে... । বয়স তো আমাদের ও হয়েছে...।। দেখ...... এটাই হয়ত আমাদের শেষবারের যাওয়া......। তাই বলছি 'চল'। জানি তুই ব্যাস্ত মানুষ। তোর হয়ত একটু অসুবিধে হবে। কিন্তু অসুবিধে করেই না হয় গেলি...।। বাদলের খবরটা পাওয়ার পর থেকেই কেন জানিনা মনে হচ্ছে একবার হরিসছন্দ্রপুর যাব। গত দু বছর আগে এক সহকর্মীর মারফত আলমের সাথে যোগাযোগ হয়...।। আর এই সেদিন তোর সন্ধান পাই। তখনই ভেবেছি আমরা তিন জন মিলেই যাব। অন্তত একবার...।। ---এক নিশ্বাসে কোথা গুলো বলে গেল পুলক।
মিতালির দেওয়া জলটুকু শেষ করে একটু বল পেলেন অনিকেত। বললেন -- 'কবে যাওয়া?'
'আজ রাতে। ৮:৫০ এ হাটে বাজারে এক্সপ্রেস। শিয়ালদহ থেকে। আলম এখন বিহারে থাকে ---- ভাগলপুরের কাছে। ও ওদিক থেকে আসবে। আগামী কাল সকালে আমরা তিনজন হরিশ্ছন্দ্রপুরে......বুঝলি......।" পুলক যেন মরিয়া।
'টিকিট'? অনিকেত জানতে চাইলেন।
'ধরে নে নেই... । জেনেরাল কামরায় যাব। তবে তোর কেউ চেনা থাকলে তৎকাল এ দেখতে পারিস।'
এতক্ষণে সম্বিত ফিরেছে অনিকেতের। বললেন 'দাঁড়া দাঁড়া। তোর তাড়াহুড়ো বাতিক টা যায় নি দেখছি। আমি তোকে একটু পরে ফোন করছি।'
'যাবি তো?' পুলক জানতে চাইল।
'দাঁড়া তুই...। আমি ফোন করছি তোকে' --- বলে ফোনটা রাখলেন অনিকেত। মিতালি তখনও পাশেই বসে।
অবাক করা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল মিতালি। জিজ্ঞেস করল 'শরীর খারাপ লাগছে? কি হয়েছে? কার ফোন?' একে একে মিতালির প্রশ্ন গুলোর জবাব দিলেন অনিকেত। মিতালিকে অনিকেত হরিশ্ছন্দ্রপুরের কথা বললে ওই ইন্দ্রজাল কমিকস এর চার বন্ধুর কথা আগে কোনদিন বলেন নি । মিতালিকে ফোনের ঘটনাগুলো বলতে বলতে অনিকেত মাঝে মাঝে খেই হারিয়ে ফেলছিলেন...। বিশেষ করে বাদলের কথাটা বলতে গিয়ে গলাটা একটু ধরেই গেছিল। সবকথা ধৈর্য ধরে শুনল মিতালি। শেষে জিগ্যেস করল 'যাবে নাকি তুমি?'
************** হরিসছন্দ্রপুর নামটা কতদিন পরে কানে পড়ল অনিকেতের। ওখানকার গাছ পাথরের মধ্যেই তো অনিকেতের ছেলেবেলা কেটেছে। গোপালচন্দ্র মেমোরিয়াল বিদ্যাপীঠ - মানে তো সেই অবিনাশ বাবুর বেতের বাড়ি, গোস্বামী বাবুর বাংলা ক্লাস, হেড মাসটার সুধন্য কান্তি দাসগুপ্তের চকচকে টাক, গেটের বাইরের ঘুগ্নি-হজমি, 'আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে' ----- আরও কতও কি। মাস্টার মশাইরা কি এখনও আছেন ওখানে? দেখা হলে কি এখনও ইতিহাসের স্যার ভবানী বাবু 'কি হে ছোকরা' বলে উঠবেন? ভদ্রলোকের পেয়ারা ডালের বেতের কথা ভালোই মনে আছে অনিকেতের। আর ওদের ওই চার মগজের ইদ্রজাল??? আলম তাসের ম্যাজিক শিখেছিল ওর মেজমামার কাছ থেকে তাই ও মানড্রেক, পুলকের চিরকালই দশাসই চেহারা --তাই ও ছিল লোথার। বাদলের একটা মুখোশ ছিল আর কোথা থেকে একটা আংটি জুটিয়েছিল --- তাই ও ছিল বেতাল। কিন্তু অনিকেতের নিজের নামটা কেন বাহাদুর হয়েছিল সেটা অনেক ভেবেও মনে করতে পারলেন না। এই চার মগজের প্রিয় একটা খেলা ছিল 'টীপ the ট্রেন'। মানে আলজমি থেকে কাদার গোল্লা পাকিয়ে ট্রেনের জানলা তাক করে ছোঁড়া। সবথেকে এই খেলায় ভালো ছিল বাদল। তবে ব্যাপারটা একবার ওই ভবানী বাবুর চোখে পরে এবং তার পর ওই পেয়ারা ডালের বেত.........। আজও পিঠের ব্যাথাটা টের পেলেন অনিকেত।
চা নিয়ে ঘরে ঢুকল মিতালি। বলল 'কি ঠিক করলে? যাবে?' অনিকেত দড়াম করে বিছানায় একটা ঘুষি মেরে বলল 'যাব'। তুমি জানো মিন্টি............এই ব্যাটা পুলক প্রত্যেকবার দুর্গা পুজোর ভাসানে কপালে ইয়া বড়ো একটা তিলক কেটে নাচতে নাচতে যেত এবং প্রত্যেকবার নতুন জামা কাপড়ে কাদা মাখা মাখি করে বাড়ি ফিরত। আর ওই আলম ---- একটু ট্যাঁরা ছিল ---- আর সেই সুযোগে পরীক্ষার হলে বেমালুম টুকত পাশের জনের খাতা থেকে ---- ওকে ধরে কার বাপের সাধ্যি। আর ওই বাদল............
অবাক হয়ে মিতালি দেখছিল এই মানুষটাকে। আজ প্রায় উনিশ বছর বিয়ে হয়েছে ওদের। কিন্তু এই মানুষটাকে আজ যেন প্রথমবার দেখছে মিতালি। নু ইয়র্কের প্রথম দিকে হয়ত কিছুটা এমন দেখেছিল --- কিন্তু তারপর থেকে কেরিয়ার, টাকা, দায়িত্ব, ছেলে, ফ্ল্যাটের EMI, অফিসের চাপ - সব মিলিয়ে মানুষটা কেমন যেন 'অতি সাবধানী' হয়ে উঠেছিল। শেষ কবে মন খুলে অনিকেতকে হাসতে দেখেছে মিতালি --- জানে না। মিতালিকেও কোনদিন জোর করে বাধা দেয়নি অনিকেত। মিতালির উড়িষ্যার চাকরি, গৌহাটির চাকরি, সৃজনকে ওর মামারবারিতে মানুষ করার সিধান্ত -- কিছুতেই বাধা দেয় নি। কিন্তু সেই অনিকেত আজ বেশ অন্যরকম......। এটাই ভালো লাগছিল মিতালির।
অনিকেতকে থামিয়ে বলল 'যাবে যখন... তাহলে জানিয়ে দাও। আর পুলকবাবুর নাম বয়সের details টা নিয়ে নিও। ছোড়দার একজন চেনা ট্রাভেল এজেন্ট আছে। কোন ট্রেনে যাবে? দেখি উনি তৎকালে টিকিটের ব্যাবস্থা করে দিতে পারেন কিনা'? এক লাফে অনিকেত বিছানা ছেড়ে উঠে মিতালির গালটা টিপে দিয়ে বলল 'জো হুকুম ম্যাডাম'।
শেষ অবধি সেই ট্রাভেল এজেন্ট টিকিটের ব্যাবস্থা করে দিয়েছিলেন। মিতালির কাছে যখন এস এম এস টা আসে ততক্ষণে অনিকেত ট্যাক্সি নিয়ে শিয়ালদার পথে। এস এম এস টা অনিকেতকে forward করে দিল মিতালি। এক মিনিটের মধ্যে এক গুচ্ছ smiley সহ মিতালি যে এস এম এস টা পেল সেটার কথা না হয় উঝ্যই থাক। মুচকি হেসে সৃজনের নম্বরে চাপ দিল মিতালি।
************** গল্প টা এখানেই শেষ হতে পারত। শেষ হলেও কিছু বলার ছিল না। তবে পাঠককুলের জন্য কয়েকটা খবর দেওয়া দরকার।
প্রথমত পুলকবাবু Laboratory Instrument এর dealer. সেই সুবাদেই তার মিতালির গৌহাটির কলেজে আগমন এবং কথা প্রসঙ্গে আসে হরিসছন্দ্রপুরের কথা... অনিকেতের কথা। ঘটনাটা মিতালির কলকাতায় আসার দুদিন আগে। দ্বিতীয়ত মিতালি যে অনিকেতের স্ত্রী সেটা জানবার পর পুলকবাবু ওই চার মগজ ইন্দ্রজালের কথাও বলেন। এটাও জানান যে আগামী রবিবার তাদের মধ্যে দুই মগজের হরিসছন্দ্রপুর যাওয়ার কথা। আইডিয়াটা তখনই মিতালির মাথায় আসে। অনিকেতের ফোন নম্বর মিতালিই দেয় পুলকবাবুকে......তবে ফোন নম্বরের উৎস গোপন রাখতে বলে। এটাও বলে দেয় শনিবার রাতে বা রোববার সকালের আগে যেন উনি অনিকেতকে ফোন না করেন। তৎকালের টিকিটের ��থা ছোড়দার ওই বন্ধুকে আগে থেকেই জানিয়ে দিয়েছিল মিতালি। তারপর শনিবার দুপুরে প্রোজেক্টের বাহানা দিয়ে অনিকেতকে ফোন করে কিন্নর কল্পার প্ল্যান ভেস্তে দেওয়ার কাজটা নিপুণ ভাবে করে সৃজন। ছেলেকে মানেজ করতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি মিতালির ---- উলটে সৃজন বলেছিল "মা...this is a life time opportunity for Baba.....Baba should not miss it!!". কোথাও একটা নিজের ছেলের ওপর বেশ গর্ব অনুভব করেছিলেন মিতালি ...... কাছে পেলে হয়ত জড়িয়েই ধরতেন।
0 notes
Text
'পট'কথার চুপকথা
উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকার 'রংদার রোববার' বিভাগে জুন ২০১৮ তে প্রকাশিত
"ভাগ্যিস জগন্নাথদেবের জ্বর হয়েছিল...... সেখান থেকেই শুরু 'পটচিত্রের'।"
"একদিন হয়েছিল কি........." ধরণের গল্প বলার জন্য আমি লিখতে বসিনি। গল্প... গল্পের জায়গাতেই থাক...... আমি বরং বাস্তবে ফিরি।
বলছি...... 'পুরী গেছেন?'
আমাকে 'আহাম্মক' ঠাহর করার আগে দ্বিতীয় প্রশ্নটা করে ফেলি।
আচ্ছা...... 'রঘুরাজপুর গেছেন? পুরী থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার।'
কি বললেন? এতবার পুরী গেছেন অথচ 'রঘুরাজপুর' নামটা শোনেননি। তবে সেটা আপনার দোষ নয়। আমার-আপনার মত 'বিজ্ঞ' মানুষগণ তো বিজ্ঞাপন দেখেই তেল-সাবান-শিক্ষা-চিকিৎসার পেছনে দৌড়য়। 'যাহা আছে প্রচারে...... তাই-ই আছে গোচরে'। তাই ঐ ১৪ কিলোমিটারের রাস্তায় রঘুরাজপুরের একটিও বিজ্ঞাপনী হোরডিং না দেখে একটু আশাহত হয়েছিলাম বইকি। যাই হোক রঘুরাজপুর সম্পর্কে শ্রীমান উইকিপিডিয়া যা বলছে -- হুবহু টুকে দিলাম ---- "In 2000, after a two-year research and documentation project by INTACH, starting 1998, the village was chosen to be developed as state's first heritage village and developed as a Crafts village, soon the village had an interpretation centre, commissioned artwork on the walls of the artists’ homes and a rest house"।
চন্দনপুর বাজারের থেকে ডানদিকের একটি রাস্তা ধরে যেখানে পৌঁছলাম সেটি আপনার আমার খুব চেনা আর চার-পাঁচটা গ্রামের মতই--- রাস্তায় ট্রাক্টর, মাঠে তক্তা দিয়ে ক্রিকেট খেলা, কুঁড়েঘরের দাওয়ায় বাসনকোসন আর একটি মাঝবয়সী গরুর নির্বাক চাউনি...... বেজায় আটপৌরে। পার্থক্যটা বুঝলাম অটো থেকে নামার পরে।
দু তিনজন মানুষ এগিয়ে এসে একপ্রকার 'নেমন্তন্ন'ই করে ফেললেন তাদের বাড়ি যাওয়ার। যথেষ্ট মার্জিত ভদ্র ব্যবহার। যেতে যেতে শোনাতে লাগলেন তাদের গ্রামের ইতিহাস। রাস্তার দুধারের প্রত্যেকটি বাড়ির দেওয়াল বিভিন্ন রঙে রাঙ্গানো সঙ্গে মানানসই আঁকিবুঁকি। জানতে পারলাম পণ্ডিত কেলুচরন মহাপাত্রের জন্মস্থান এই রঘুরাজপুরেই। ঘরে নিয়ে গিয়ে মাদুর বিছিয়ে বসে দেখাতে শুরু করলেন একের পর এক অসামান্য সব পটচিত্র। ইতিহাস বলছে -- এই পটচিত্রের জন্ম প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। কথিত আছে যে জগন্নাথদেবের জ্বর হওয়ার কারণে ওনার পটচিত্র আঁকা হয় দর্শন-পিপাসু ভক্তকূলের জন্য। সেই থেকে ফি বছরে পনেরদিন বিগ্রহের বদলে জগন্নাথদেবের পুজো হয় পটচিত্রে।
'পট' অর্থাৎ কাপড় আর তালপাতার ওপর অসামান্য কারুকাজ দেখাতে দেখাতে ঝপ করে খাতা হাতে একটা কৃষ্ণের অবয়ব এঁকে তুলি দিয়ে রং করা শেখাতে লাগলেন। মুহূর্তের মধ্যে তালপাতার ওপর ফুটে উঠলো মানুষের মুখ। কথার ফাঁকে ফাঁকে দুটি ছবিকে সামনে রেখে তুল্য মূল্য বিচার করে 'ভালো ছবিটির' দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে জানান দিলেন যে 'ঐটি ওনার বাবার কাজ' আর অন্যটি... মানে 'কম ভালোটি' ওনার নিজের আঁকা। অবলীলায় বললেন 'বাবা প্রায় ষাট বছর ধরে কাজ করছেন আর আমি মাত্র তিরিশ...... তাই...।' বোঝা গেল এনারা জন্মগত শিক্ষক। আর সেটা বলেই আড়াই হাজার বছরের শিল্পকে বংশ পরম্পরায় এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে বাড়ির প্রত্যেকটি সদস্যই যেখানে শিল্পী আর গোটা বাড়িটাই থুড়ি গোটা গ্রামটাই একটা ছবি।
গোটা গ্রামের তখন আমরাই একমাত্র অতিথি। গ্রামের পথ ধরে যত এগিয়েছি প্রায় প্রত্যেক বাড়ি থেকেই নির্ভেজাল নেমন্তন্ন এসেছে তাদের রংবাহারি কাজ দেখে যাওয়ার জন্য। এই হরেক কিসিম 'রংবাহারির' মুল রং মাত্র পাঁচটি, যা তৈরি করা হয় বিভিন্ন পাথরের গুঁড়ো বা গাছ থেকে। হলুদ (হরিতালি), লাল (হিঙ্গুলা), নীল (রামরাজা) , সাদা (শাঁখ) আর কালো রঙের জন্য কাজল (বা প্রদীপের কালি)। এই পাঁচটি রঙের বিভিন্ন মিশেলে তৈরি হয় বাকি সব রং। একগোছা তুলি সহ নারকোলের মালায় রংগুলে প্রায় প্রত্যেক বাড়ির দাওয়ায় বেলাশেষের আলোতে নিজেদের ছবিতে মগ্ন এই চিত্রকরেরা। কেউ আবার মূর্তি গড়ছেন........কেউ আবার ছোট ছোট খেলনা বানাচ্ছেন। পটচিত্র ছাড়াও নারকোলের মালার বা সুপুরির ওপর সূক্ষ্ম কাজ, রংবেরঙের কাঠের পুতুল, চমক ধরানো মুখোশ, তসরের ওপর অনবদ্য আঁকিবুঁকি............ সে সব ছবির-মূর্তির-শিল্পের গুণাগুণ বা কাজের সূক্ষ্মতার বিচার করার ক্ষমতা আমার অন্তত ছিল না...... করতে যাইও নি। প্রচার বিমুখ, ব্যবসা বিমুখ এক গ্রাম মানুষ গুলো ছবি নিয়ে কথা বলেই আবার মন দিচ্ছিলেন নিজেদের কাজে। বিশ্বাস করুন একটি বারের জন্য কিনবার জন্য কোনও জোর করতে দেখলাম না।
রাষ্ট্রপতি পুরস্কার অবধি প্রাপ্ত এদের কয়েকজনের। তবে কেউই একবারের জন্যও প্রশ্ন করলেন না 'মশাই... আপনি কে? ক্যামেরা কাঁধে ছবি তুলে বেড়াচ্ছেন...... অথচ আপনার নিজের সৃজনশীলতা কতদূর?' আমি তো বিলক্ষণ জানি যে রং তুলির সাথে আমার সম্পর্ক কয়েক যোজন দূরের। ছোটবেলায় নিয়মমাফিক 'আঁক কষতে' শুরু করেছিলাম বটে তবে সেই জল ঐ...... 'চোঙাকৃতি পাহাড়ের আড়ালে সূর্যোদয়' বা ওই 'কুঁড়েঘরের পেছনে নারকেল গাছের' বেশি এগোয়নি। জীবন বিজ্ঞানের ছবি কোনমতে বই দেখে উৎরেছি। তাই আমার মত 'অশিল্পীর' বয়ানে শিল্পের গুণাগুণ বেমানান। তাই আমি অবাক চোখে মানুষগুলোকে দেখেছি...... আর দেখেছি সৃষ্টির নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা তাদের দীর্ঘ নির্লোভ অধ্যাবসায়। যা শুধু বইতেই পড়েছিলাম......... ইতিহাসকে চাক্ষুষ করলাম রঘুরাজপুরে গিয়ে --- আড়াই হাজার বছরের শিল্প ও তার শিল্পীদের চুপকথায়......।।
আরও বিশদে জানতে পড়ুন
১। উড়িষ্যার পটচিত্র https://www.ijrra.net/Vol2issue4/IJRRA-02-04-17.pdf
২। বাংলার পটচিত্র https://www.arcjournals.org/pdfs/ijhcs/v1-i1/1.pdf
0 notes
Text
ঐ অরণ্যে
তেরাই এর জঙ্গল এ যাবো শুনে এক সহকর্মী বললেন "Dooars? কিছছু পাবেন না দাদা। মরা খেকো জায়গা । গেল বার গরমের ছুটি তে ......।"
সত্যি বলতে আমাকে জঙ্গল সেরকম ভাবে কোনদিন ই টানে নি। আমি পাহাড় আর ঐতিহাসিক স্থান বেড়াতে পছন্দ করি। জঙ্গলে গিয়ে বাঘ, হাতি, শিপাঞ্জির দেখা পাওয়ার থেকে ওনাদের না দেখতে পাওয়াটাই আমার কাছে বেশী সৌভাগ্যের। আমি ছাপোষা লোক, আজ অবধি 'Homo Sapiens' নামক প্রজাতি-র মতি গতিই বু ঝে উঠতে পারলাম না... তো ওই বাঘ, হাতি?
এই প্রথম জঙ্গলে যাচ্ছি। দোলের ছুটি র সাথে কোনক্রমে একটা দিন ছুটি পেয়েছি...তাতে ঘরের দুয়��রের Dooars ছাড়া আর কি ছু হবেও না। জঙ্গলে হাতি আমাকে 'Gun Salute' দেবে আর পায়ের কাছে চিতাবাঘ মেনি বেড়ালের মত ঘুরে বেরাবে...এতটা আশা না করলেও......কোনও জন্তু দেখতে পাব না জেনে একটু মনখারাপ হল বৈকি। যাই হোক... মনখারাপ নিয়ে-ই চেপে বসলাম বাঙ্গালীর প্রিয়তম ট্রেন 'দার্জিলিং মেল' এ। সেদিন কলকাতায় ভারী বৃষ্টি।
পরদিন সকালে নিউ জলপাইগুড়িতে নেমে বুঝলাম আকাশেরও মুখভার। গাড়িতে করে লাটাগুড়ির Resort এ যাওয়ার পথে চারপাশ কালো করে বৃষ্টি নামল। ড্রাইভার জানালো এমন বৃষ্টি হলে জঙ্গল সাফারিও হবে না এবং হলও তাই। বৃষ্টি থামতে থামতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল এবং স্বাভাবিক ভাবেই জঙ্গল সাফারি cancel। সন্ধ্যে বেলায় আবার বৃষ্টি এবং সেই অফিস বন্ধুর ফোন। দুইয়ে মিলিয়ে রাতের মুরগির ঝোলটাও বিস্বাদ লাগছিল।
আমাদের Resort টি ছোট হলেও গরুমারা জঙ্গলের ঠিক পাশেই। কোনও নতুন জায়গায় গেলে ভোরবেলায় উঠে একটা চরকি চক্কর দেওয়া আমার অভ্যেস। তাই খুব ভোরে বেরলাম জঙ্গলের রাস্তায়। গাছের ফাঁক দিয়ে ঝকঝকে রোদের ঝিকিমিকি আলো আঁধারি, নাম না জানা কত গুলো পাখির ডাক আর সঙ্গে শিরশিরানি দেওয়া ঠাণ্ডা হাওয়া.......। মাঝে মাঝে জঙ্গলের ভেতর থেকে ময়ূরের ডাক। সব মিলিয়ে এক নিমেষে মনখারাপ হাওয়া। Resort-এ ফিরে breakfast সেরে গাড়ি নিয়ে সারাদিন ধরে ঘোরা হল মূর্তি, ঝালং, বিন্দু, সালতানিখলা, চাপরা মারি, সামসিং, Rocky Island। জলঢাকা নদীর ধারে বসে বিন্দুতে Lunch খাওয়া হোল। আলাদা করে বলব সালতানিখলা ও চাপরামারি র কথা। সেই অর্থে কিছুই নেই এই দুটো জায়গায় এবং সেটাই আমার ভালো লাগার একমাত্র 'নিস্তব্ধ' কারণ। খুব শিগগিরি আবার দেখা হবে এই দুটো জায়গার সাথে।
পরদিন উঠলাম রাত সাড়ে তিনটে......উদ্দেশ্য জঙ্গল সাফারির টিকিট।
দোলযাত্রার কল্যাণে বাইরে তখন 'চাঁদের হাট'। সেই আলোতে জঙ্গলের তখন আর এক রূপ। টিকিট পাওয়া যাবে ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে। দোলের ছুটি তে ভিড় বেশী তাই চারটে থেকে খোলা আকাশের তলায় কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে টিকিট পেলাম। একেকটি গাড়িতে ছয় জন। গাইড, গাড়ি ও entry fee নিয়ে গাড়ি প্রতি ২০০০ টাকা মত পড়ল। সকাল সাড়ে ছয় টা থেকে সাড়ে আটটা-হুড খোলা Gypsi গাড়িতে জঙ্গল চক্কর দিলাম। জঙ্গলের মধ্যে গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্য ওঠার সময়কাল একটা সারা জীবনের প্রাপ্তি। কোথাও রোদ ঝলমলে, কোথাও গভীর অন্ধকার, কোথাও একটা ছোট জলা আর প্রতি ক্ষণে ডাইনে বাঁয়ে কোনও অজানা কি ছু র খোঁজের রোমাঞ্চ......আর যাই হোক ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না (অন্তত আমার দ্বারা)। আর জন্তু ? উপরি হিসেবে তাও দেখেছি...। খান কতক ময়ূর, একটা হরিণ আর গোটা দুই বন মুরগী।
রাতে বরুলি মাছের পদ দিয়ে ডিনার এর পর শোয়ার তোড়জোড় করছি...এমন সময় দরজায় ধাক্কা। দুটো বুনো শুয়োর Resort এর বাইরে দেখা গেছে। টর্চ নিয়ে আমি সোজা বারান্দায়। মিনিট পাঁচেক দাঁড়ানোর পর দেখা পেলাম তেনাদের। ভাঁটার মত দু জোড়া চোখ ইতিউতি ঘোরা ঘুরি করে মিনিট দশেকের মধ্যে জঙ্গলে ফিরে গেল। মিনিট দশেক পর তারা আবার ফিরে এলো। পাঁচ- সাত মিনিট কাটিয়ে জঙ্গলে ফিরে গেল। Resort-এর watch-guard থেকে জানলাম যে দিন তিনেক আগে হাতীর পাল এসে ভোররাতে দাপাদাপি করে গেছে। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল সেই অফিস বন্ধুটিকে একবার ফোন করার। ইচ্ছে সংবরণ করে...আরও আধ ঘণ্টা খানেক বারান্দায় থেকে ঘরে ফিরে এলাম।
সেইরাতে আবার ভোর সাড়ে তিনটে---চাঁদের আলোতে জঙ্গল দেখতে দেখতে টিকিট কাটতে বেরলাম। উদ্দেশ্য যাত্রা প্রসাদ Watchtower আর Rhino view point। চারটের সময় আমি এগারো নম্বরে। যাত্রা প্রসাদ ছাড়াও আরও তিনটে Watchtower এর টিকিট ওই একই জায়গা থেকে পাওয়া যায় - মেদলা, চাপরা মারি আর চুকচুকি। আমার নম্বরে যাত্রা প্রসাদের টিকিট শেষ...। আমি মেদলার টিকিট পেলাম (গাড়ি প্রতি ২০০০ টাকা মত পড়ল)। গতদিনের জঙ্গলের অভিজ্ঞতা কে আর একবার চেটে পুটেখেতে খেতে মেদলা চললাম। চা বাগানের মধ্যে দিয়ে ছবির মত রাস্তা । মেদলার শেষ এক কিমি আবার মোষের গাড়িতে করে যেতে হয়। সেও এক উপরি পাওনা। মেদলা watchtower থেকে বাইসন, হাতি, ময়ূর দেখে আমারা ফেরার রাস্তা ধরলাম। ফেরার পথে আরও দুটো চমক ছিল আমাদের জন্য---- ১) জঙ্গলের মধ্যে একটা নাম না জানা সরু খাল এ মিনিট পনের নৌকা ভ্রমণ (এটা মেদলা package এর মধ্যে ই পরে) আর ২) এক ময়ূরের পেখম তুলে প্রায় মিনিট সাতেক ধরে আনমনা নাচ।
ফিরে সেই সহকর্মী র সাথে দেখা হয়েছিল। একগাদা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন আমার দিকে - "আহ ! গণ্ডার দেখতে পান নি?" "বাইসন কত কাছ থেকে দেখেছেন?", "হাতীর পাল দেখেছেন?" ............কি বলব ভেবে পাইনি। হাল্কা হেসে বেরিয়ে গেছি। 'বৃষ্টি' র জঙ্গল, 'চাঁদের হাট' এর জঙ্গল, নিস্তব্ধতার জঙ্গল, -- আর যাই হোক ওই ভদ্রলোক কে বোঝানোর সাধ্যি আমার অন্তত নেই।
0 notes
Text
দারিংবারি
কেন যাবেন না...... বা যাবেন...।
এ সি কামরার ভালো হোটেল নেই। যা আছে সেখানে টিম টিম করে আলো জ্বলে । Room service বলে কিছু নেই। বৃষ্টি হলে ছাতা মাথায় দিয়ে খেতে যেতে হবে।
রাতে মশারি টাঙ্গিয়ে শুতে হবে। সন্ধ্যের পর থেকে বড্ড পোকার জ্বালাতন । সারাদিনে আবার ঝিরঝিরে বা মুষলধারে বৃষ্টি । বেড়াতে আসা প্রায় মাটি আর কি।
সন্ধ্যের পর কিছু করার নেই। মুড়ি তেলেভাজা আর এক আকাশ তারা...। গাছের আম পাবেন তবে হোটেল এর রান্না বান্না বেশ সাধারণ মানের। চাইনীজ কন্টিনেন্টাল ভুলে যান......একটু ভালো মাছ ও পাওয়া যায় না।
মোবাইল এ টাওয়ার না থাকার ই মতো। অফিস এর জরুরি ফোন গুলো ধরতে পারবেন না। ই মেইল, ফেইসবুক, ইউ টিউব এইসব তো বাদ ই দিন।
জনবসতি বলতে উল্কি আঁকা আর মাকড়ি পড়া কিছু আদিবাসী শ্রেণীর লোকের বসবাস......তাও আবার হোটেল থেকে অনেক দূরে। শহুরে সভ্যতার (?) ছাপ প্রায় নেই বললেই চলে। কোল্ড ড্রিংক বা চিপস এর প্যাকেট অবধি পাওয়া দুষ্কর ।
Sight seeing বলতে 5-পয়েন্ট, 7-পয়েন্ট এসব কিছুই নেই। সবুজ ঢাকা পাহাড়ে মেঘের ইতিউতি, অচেনা ঝরনা, নাম নাজানা পাখির ডাক, পাইন গাছের সারি, এক চিলতে পাহাড়ি নদী, হরেক রকম প্রজাপতি ......অনেকটা যেদিকে sight সেদিকে seeing এর মতো। টাকা খরচা করে গাড়ি নিয়ে এসব ঘুরবেন?
শেষ পাতে গোপালপুর যেতে পারেন ... যা পুরী বা ভাইজাগ এর কাছে নিতান্তই শিশুসুলভ মনে হতে পারে আপনার ।
ভেবে দেখুন...।!
0 notes