Tumgik
#চাকরি পাওয়ার দোয়া
luckytigerbird · 2 years
Text
আকর্ষণীয় বেতনে ডিবিএল ফার্মায় চাকরির সুযোগ
আকর্ষণীয় বেতনে ডিবিএল ফার্মায় চাকরির সুযোগ
ডিবিএল গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ডিবিএল ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড জনবল নিয়োগের লক্ষ্যে ওয়াক ইন ইন্টারভিউয়ের আয়োজন করেছে। ২০ মে অনুষ্ঠেয় ইন্টারভিউ থেকে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে টেরিটরি অফিসার, সিনিয়র টেরিটরি অফিসার ও টেরিটরি এক্সিকিউটিভ পদে তিন শতাধিক জনবল নিয়োগ করা হবে   টেরিটরি অফিসার পদে অনভিজ্ঞ প্রার্থীরাও আবেদন করতে পারবেন। তবে ন্যূনতম যোগ্যতা হিসেবে স্নাতক পাশ এবং এসএসসি পর্যায়ে জীববিজ্ঞান বিষয় থাকতে…
Tumblr media
View On WordPress
0 notes
manayeem · 3 years
Text
সায়েন্স ফিকশন
ভাইরাস প্রথম অধ্যায়
১। "কাল রাইতে নাকি মিন্টু ঢাকা থাইকা ফেরত আইছে?" সামসু জিজ্ঞাসা করল। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সামসু হাশেমের সাথে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেয়। সামসুর প্রশ্ন শুনে হাসেম একটু ভ্রু কুচকালো। বলল "হ, আমিও শুনছি মিন্টু বাড়িতে আইছে হঠাৎ করে। কি একটা না কি হইছে ঢাকা শহরে।"
"ও রহমান চাচা কি হইছে ঢাকা শহরে? তুমি জানো কিছু?" সামসু দোকানের ভেতরে গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল। রহমান চাচার ২০ বছরের দোকান এই তল্লাটে। এলাকার সব খবরা-খবর তার কাছে থাকে। সে গ্রামের বিবিসি।
"কি একটা অসুখ আইছে নাকি ঢাকা শহরে।" রহমান বলল। "সেই অসুখ থাইকা বাঁচতে মিন্টু বাড়ি চইলা আইছে।"
"বল কি চাচা! কি এমন অসুখ? আমরায় তো কিছু শুনলাম না"
"আমিও কিছু জানি না। তবে শুনছি মরন অসুখ। হইলে আর রক্ষা নাই।" ভয়ার্ত চোখে বলল রহমান চাচা। 
সামসু আর হাশেম দুজনই বিচলিত তার কথায়। ওদের ভাবনায় আসছে না কী রকম অসুখ যার কথা কারো জানা নাই আর হলেও নাকি কারো রক্ষা নাই। 
"চল কাল সকালে আমরা মিন্টু ভাইয়ের বাড়ি গিয়ে সাথে দেখা করে আসি।" হাসেম বলল।
"হাঁ ঠিক কইসস। তার সাথে একটু দেখা করে আসা দরকার। কি খবরা-খবর। কেন সে আসছে ঢাকা ছাইড়া।" পান চিবোতে চিবোতে দুজনে বাড়ির পথে রওনা দিল।
করিম বক্স সারাদিন ক্ষেতে ছিল। সন্ধ্যার পরে বাড়ি ফিরেছে। আসার পথে গঞ্জ থেকে হাতে করে এক প্যাকেট সন্দেশ নিয়ে এসেছে। তার পাচ পাঁচটা ছেলে। সব থেকে বড়টাকে ছোট্টু ডাকে সে। তার সাথে গঞ্জে যায় ছোট্টু। আজ অবশ্য যায়নি। আর সবার ছোটটা হাটি হাটি পা পা করে এখন দৌড়ে বেড়ায় সারা বাড়ি। এদের জন্য প্রতিদিনই হাতে করে কিছু না কিছু নিয়ে আসতে হয়। আজকে সন্দেশ নিয়ে এসেছে করিম বক্স। সন্দেশ হাতে দিয়ে সারতে পারে নাই, সাথে সাথেই তা ছিড়ে লণ্ডভণ্ড করে ফেলেছে তার পাঁচ গুণধর পুত্র। সবার হাতে সন্দেশ শুধু ছোটটা ছাড়া। ওর সন্দেশটাতে ভাগ বসেছে সেঝোটা। করিম বক্স এর সেঝো ছেলেটা সবচেয়ে দুষ্ট। সবাই ওকে কালু বলে ডাকে। বাপের মত কালো হয়েছে তো গায়ের রং, তাই। 
এদিকে ছোটটা কান্না জুরে দিয়েছে। ছোট্টু কালুর হাত থেকে সন্দেশটা কেড়ে নিয়ে ছোটটার হাতে দিল। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ওর কান্না থামানো কি চাট্টিখানি কথা। 
নীরব নিস্তব্ধতার এই গ্রামদেশে সূর্য ডোবার পরে শ্মশানের মতো ভূতুরে হয়ে পড়ে চারিপাশ। তারমধ্যে রহিম বক্সের এই ছোট ছেলের কান্নার শব্দ দূরদূরান্ত পাড়ি জমায়। সেটা প্রতিদিনকারই ঘটনা। ওদের বাড়ির আশেপাশে কোন বাড়িঘর নেই। প্রতিবেশী বলতে বেশ কয়েকটা ধানী জমির পরে মিলিটারিদের বাড়ি। 
ছোট ছেলের কান্নাকাটিতে রহিম ব���্সের বউ ছাড়া আর কেউ তাই খুব একটা বিরক্ত হয় না। রহিম বক্সেরও তা গা সওয়া। কিন্তু আজ কি যেন একটা হল রহিম বক্সের। মেজাজটা বিগড়ে গেল খুব। কোন এক কারণে মুখ ভার করে গঞ্জ থেকে ফিরেছে রহিম বক্স। কারণটা তার স্ত্রী বা পুত্রদের কারো জানা নেই। রহিম বক্স ধৈর্য ধরে রাখতে না পেরে খেঁকিয়ে উঠলো। সাথে সাথে তার স্ত্রী বিছানা থেকে উঠে বসলো আর ছোটটাকে ধরে কষে একটা থাপ্পর দিল। "গোলামের পো গোলাম!" বলে এক রাশি গালি ঝারল সে। "বাপের লাইন হইছে তার মেজাজ!" রহিম বক্স এর বউ খেকিয়ে উঠলো। 
রহিম বক্স মেজাজ ধরে রাখতে পারলো না। এক লাফে কালুর সামনে গিয়ে দাড়াল, চিতকার করে বলল, "হারামজাদা! তোর কোন কাজ নাই! তোর জন্য কি আমি সন্দেস আনি নাই? তারপরেও তুই কেন ওরটা ধরতে গেছোস?" বজ্রকন্ঠে ছেলের উপর চড়াও হল সে। "আমার সন্দেশ আনাটাই মহা ভুল হইছে। এইসব না আনতাম কিছুই ঘটত না। তোদের জন্য আর কোনদিন কিছু আনবো না আমি। তোরা কোন কিছু পাওয়ার লায়েক না।" মুহুর্তের মধ্যে পুরো বাড়ি জুড়ে একটা অস্থির গমগমে পরিবেশ তৈরি হয়ে গেল। রহিম বক্স ও তার স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়ে গেল।
ছোট্টু এই পরিবেশের মধ্যে ভাইদের তার সাথে বাইরে বেরিয়ে উঠোনে আসতে বলল।
"কালু, উঠোনে চল।" কালু নড়তে নারাজ। ছোট্টু ওর হাত ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে গেল। ওদের সাথে মেজোটাও বাইরে বেরিয়ে এলো। "তুই সব সময় ওর সাথে এরকম করিস কেন? ও তো সবার ছোট ওর সাথে তোর এরকম না করলে হয় না!" কালু কোন উত্তর দিল না। ওর মুখ ভর্তি সন্দেশ। 
"দিলি তো খামোখা বাজানের মেজাজটা গরম কইরা। আইজ সারারাত তার মেজাজ চিলেকোঠায় থাকবো।" মেজটা বলল। এমনি বাজান যে খিটমিট করে সারাক্ষন৷ ভাবছিলাম কালকে একটা বল আনতে কমু বাজানরে।" মেজোটা বলে চলল। "আর বল আমাদের হইছে। নারকেল গাছের পাতা দিয়ে বল বানায় খেলে খেলে জীবন শেষ হইব।"
হঠাত উঠোনের ওপাশ থেকে এক ধরনের শব্দ আসতে লাগলো। ওখানে লাউ গাছের ঝার রয়েছে। মনে হচ্ছে শব্দটি লাউ গাছের ঝারের ভেতর থেকে আসছে। মেজটা হকচকিয়ে উঠলো। "ভাই কিরে ওইখানে?" বলল সে।
"চল ঘরে চল শেয়ালের উৎপাত এমনি অনেক বাড়ছে, ভেতরে চল।" বলে ছোট্টু বাকি দুই ভাইকে টানতে টানতে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল। কম বয়স বলেই কিনা! ভয় পেল মনে হয় একটু।
"মিলিটারি তুই কই গেলি? আমারে একটু পায়খানা নিয়ে চল। আমারে কেউ পায়খানায় নিয়ে চল।" খুনখুনে  গলায় চেচাল বুড়ি। কুজো বুড়ি বলে ডাকে ওকে গ্রামের সবাই। ওর একটা ছেলে আছে, যে এক সময় সেনাবাহিনীর সৈন্য হিসেবে চাকরি করতো। পরে কোন এক কারণে সে সেখান থেকে চলে আসে। তবে কি কারনে চলে আসে সে সেটা কারো জানা নেই। সেই তারপর থেকে বুড়ির ছেলেকে সবাই মিলিটারি নামে ডাকে। গ্রামের অনেক লোক আছে যারা তার আসল নামটাই জানেনা। অবশ্য কুজো বুড়ি ওকে ব্যঙ্গ করে মিলিটারি ডাকে।
মিলিটারি উঠোনে বসে বিড়ি খাচ্ছিল। মায়ের চিৎকার শুনে সে পড়িমড়ি করে দৌড়ে গেল ঘরের ভেতরে। 
"আরে গোলাম! কতক্ষণ ধরে আমি চিল্লাইতেছি।" কুঁজো বুড়ি খেঁকিয়ে উঠলো। "আমারে পায়খানা নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা কর।" এটা অবশ্য নতুন কিছু না মিলিটারির জন্য। মাকে নিয়ে উঠাবসা, চলাফেরা, খাওয়ানো দাওয়ানো সবই মিলিটারির কাজ। তারপরেও তার উপরই সবচেয়ে বেশি চিৎকার চেচামেচি করে বুড়ি। তার আরেকটা ছেলে আছে যদিও  কিন্তু সেই ছেলে নিয়ে মাথাব্যাথা নেই বুড়ির। বউ নিয়ে ছেলে আছে দিব্যি আরামে। বুড়ির যত রাগ সব মিলিটারির উপরই নিংড়ে দেয়। মিলিটারি মায়ের বাহুতে হাত দিয়ে পায়খানা অবধি নিয়ে গেল। 
হঠাৎ একটা খট মট শব্দ শুনতে পেল সে পায়খানার পাশের একটা ঝোপে। মিলিটারি একবার সেই দিকে তাকালো, ভাবল কোন শিয়াল-কুকুর হবে। এই গ্রামে শেয়ালের উৎপাত অনেক বেশি। সন্ধ্যা নেমে আসলে এগুলা সব বাড়ির আশেপাশে চলে আসে। 
"ওই গোলাম, খারায় থাকবি। আমার জন্য জল নিয়ে আয়।" মায়ের চিৎকারে ঘোর ভাঙলো মিলিটারির। এক দৌড়ে জল নিয়ে আসতে গেল। 
জল এনে অনেক্ষন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মিলিটারি। ঝোপের ভেতর থেকে আসা শব্দটা এখন আর নেই। 
"মা, ও মা হইল তোমার?" কিন্তু মায়ের কোন সাড়া শব্দ নেই। 
মিলিটারি আবার ডাকল, "মা হইছে তোমার?" কিন্তু এবারও কোন সাড়া মিলল না। অগত্যা মেলেটারি ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ফেলল। দরজা খুলতেই হতভম্ব হয়ে গেল মিলিটারি। ঘরের ভেতরে কেউ নেই। ঘরটা খালি।
(চলবে)
সায়েন্স ফিকশন 
ভাইরাস 
পর্বঃ ২
পরদিন সকাল
সামসু আর হাসেম মিন্টুর বাড়িতে।
"মিন্টু ভাই বাড়ি আছো নাকি?" মিন্টুর বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে হাসেম হাক ছাড়লো। 
মিন্টুর বাড়ির উঠোন ঝাড়পোঁছ করা, সবকিছু পরিপাটি, গোয়াল ঘরে গরুর শব্দ ছাড়া পুরো বাড়ি জুড়ে আর কোন সাড়া শব্দ নেই। শামসু আর হাসেমের কাছে একবারের জন্য মনে হলো বাড়িতে কেউ নেই। বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর ওরা যখন ফিরে যাবে ঠিক করেছে, তখনই বাড়ির ভেতর থেকে দরজার খিল খোলার শব্দ ভেসে এলো। সামসু আর হাসেম শব্দ শুনে ঘুরে দাঁড়ালো। কেউ একজন খুব ধীর লয়ে দরজার খিল খুলছে। ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে দরজাটা ভেতর থেকে খুলে গেল। মিন্টু দাঁড়িয়ে আছে দরজার ওপাশে। দেখে খুবই ক্লান্ত অসুস্থ লাগছিল ওকে।
"মিন্টু ভাই কেমন আছো?" নীরবতা ভঙ্গ করলো সামসু। মিন্টু কোন জবাব দিল না। সে আস্তে আস্তে দরজার বাইরে বেরিয়ে এলো। হাসেম দৌড়ে গেল ওর হাত ধরে সাহায্য করার ভঙ্গিতে কিন্তু মিন্টু মাথা নাড়লো বলল, "আমি ঠিক আছি হাসু।" একটু অবাক হয়ে মিন্টুর কাছ থেকে একটু সরে দাঁড়ালো হাসেম। ধীরে ধীরে সিঁড়ির উপর গিয়ে বসলো মিন্টু। 
"কি ব্যাপার মিন্টু ভাই, তোমার শরীরটা কি খারাপ?" সামসু জিজ্ঞাসা করল। মিন্টু কোন উত্তর করল না। সামসু একটু সামনে এগিয়ে এলো। মিন্টু কে দেখে তার কাছে অনেক অসুস্থ লাগছিল। 
"তোমার কি ঢাকায় অনেক পরিশ্রম করতে হয়? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি আগের চেয়ে অনেক বেশি শুকিয়ে গেছো। গায়ের রঙ চেপে গেছে।" মিন্টু কোন জবাব দিল না।
"ভাই চাচি কোথায়?" হাসেম জিজ্ঞেস করল। মিন্টু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল তারপর বলল "মায়ের শরীরটা ভালো নাই। ঘরে বিশ্রাম করে।"
"ভাই তোমরা তো অসুস্থ হয়ে পড়ছে তোমাদের দেখাশোনা করার কেউতো নাই।" 
"আমাদের নিয়ে চিন্তা করতে হবে না হাসেম। তোমরা আমাদের জন্য দোয়া কইরো। 
"ঢাকা শহরে কি হয়েছে?" শামসু জিজ্ঞেস করল।
"আমি পুরাপুরি জানিনা বিষয়টা।" মিন্টু বলল। "তবে কোন একটা বিদেশি অসুখ ঢাকা শহরে ছড়িয়ে  পড়তেছে। আমিতো বাড়ি বাড়ি গিয়ে ডেলিভারি করি, আমি দেখছি অনেক মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। আমি নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়ছি। সরকার সবকিছু বন্ধ কইরা দিছে। সব ধরনের প্রতিষ্ঠান কলকারখানা সব বন্ধ কইরা দিছে। সবাইকে নিজ বাড়ি চইলা যেতে বলছে। যারা ঢাকা শহরের বাসিন্দা, তাদের বাড়ি থেকে বের হতে নিষেধ করছে।"
ভীষণ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো হাসেম "কি বলো? এমন কি হইসে যে সবাইকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করছে, কল-কারখানা অফিস-আদালত বন্ধ কইরা দিছে?"
"আমি জানিনা রে হাসু। কেউই কিছু জানে না। কেউ কিছু জানার আগেই সবকিছু বন্ধ হয়ে গেছে।
আমরারে লইয়া চিন্তা করিস না তোরা। সাবধানে থাকিস। ঢাকা শহর থেকে কেউ আসলে তার উপর খেয়াল রাখিস। তার খোঁজ খবর রাখিস।"
হাসেম বলল "ভাই তোমারে দেইখা তো আমার ভালো লাগতেসে না। হাসপাতালে নেওয়া লাগবো নাকি। 
মিন্টু জোর গলায় বলল "নারে আমি এখন ভালো আছি। মায়েরে নিয়া চিন্তায় আছি। আজকে সকাল থেকে মায়ের শরীরটা খুব খারাপ। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারতাছেনা।"
"আমরা কি গিয়ে একটু দেখে আসব।" সামসু জিজ্ঞেস করে। 
"অহন থাক। মায়েরে বিশ্রাম করতে দে। তোরা এখন যা। যাওয়ার সময় আমার গরুটারে সাথে করে নিয়ে যা। গরুটা দেখশুনা করার মত সামর্থ্য এখন আমারার নাই।"
"ঠিক আছে ভাই আমরা এখন যাচ্ছি কিন্তু সন্ধ্যায় তোমারে আবার দেখতে আসবো।" মিন্টু কোন জবাব দিল না।
সামসু ও হাসেম মিন্টুর বাড়ি থেকে বের হয়ে পরলো। ওরা দুজনেই যার পর নাই অবাক হল ভেবে পাচ্ছিল না কি এমন ঘটে গেছে ঢাকা শহরে যে সবাই শহর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। 
মিলিটারির বাড়িতে শোকের ছায়া। হাউমাউ করে মিলিটারি কান্নার ধ্বনি পুরো গ্রামে ছড়িয়ে গেছে। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে মানুষ মিলিটারির বাড়িতে ভিড় করছে। 
"মা তুই কই! মা কই গেলি তুই!" মিলিটারি আহাজারি করে। পাশে উঠোনের সিঁড়িতে মিলিটারির ছোট ভাই ও তার বউ সিঁড়ির উপর বসে আছে। ছোট ভাইয়ের বউ মানুষদের সাথে চেঁচামেচি করছে। "আপনারা কি চান? মরা বাড়ি দেখতে আইছেন? মানুষ তো মরে নাই। চইলা গেছে বাড়ি থেকে। মরলে দেখতে আইসেন। এখন বাড়ি থেকে বের হন।"
"তোমার শাশুড়ির কি হইছে?" ভিড় থেকে বয়স্ক মতন এক বুড়ি মহিলা গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো। 
"আমার শাশুড়ির কি হয়েছে সেটা তো আমি নিজেও জানিনা। আপনেরা একটু বলেন, তার কি হইছে। মিলিটারিরে জিজ্ঞেস করেন। তাকে সে কোথায় ফেলায় আসেছে।"
রহিম বক্স মিলিটারির পাশে গিয়ে বসলো। একটা হাত ওর কাঁধে রাখল। "মিলিটারি আমারে খুলে বল। কি হইছে তোর মায়ের।" মিলিটারি কোন কথা বলল না। শুধু আহাজারি করছিল। ছোট ভাই বলল "মিলিটারি কোন কথা বলতেছে না কাল রাত থেকে। মায়ের কি হয়েছে সেটাও সে বলতে পারে না। আমরা অনেক খুঁজছি কিন্তু কোথাও খুঁজে পাই নাই এই বুড়া বয়সে তার তো কোন যাওয়ার জায়গা নাই। সে কোথায় যাইবে।"
"দেখো গিয়ে সখিনার বাড়ি বসে আছে কিনা?" ছোট ভাইয়ের বউ চেচিয়ে উঠল।
"সখিনার বাড়ি কোন সময় মা একা গেছে? সে একা এতদূর পথ পাড়ি দিতে পারে না সে তো আজ কত বছর হল।" ছোটভাই ধমকের সুরে বলল। 
"তাইলে কি তোমার মায়ের পাখা গজাইছে, যে পাখা দিয়ে উড়ে চলে গেছে।"
এবার মিলিটারী চিৎকার করে উঠলো "চুপ করো। আর  উল্টাপাল্টা কথা বলো না।"
"উল্টাপাল্টা কথা তো তুমি বলতেছ, মিলিটারি!" ছোট বৌ তার বাজখাই গলা চালিয়ে গেল। "যে মানুষটা ঘর থেকে পায়খানায় যেতে পারে না সে হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেল। তুমি তারে কোথায় লইয়া গেছো? কোথায় লুকায় রাখছো? কি করছ ঠিক কইরা কও মিলিটারি।" কোন কথা বলল না মিলিটারি। মাথার চুল ছিড়তে শুরু করল আর বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে লাগলো। "আরে আমিনা তুমি মুখটা একটু বন্ধ করো। দেখো না ওর মাথার অবস্থা ভালো না।"
"তোমার মার কি হইছে দেখি আমরা খুঁজে বার করতেছি। সে যদি কোথাও রাগ কইরা চইলা থাকে আমি সেইটা খুঁজে বের করমু।" রহিম বক্স বলল। "আর এই যে মানুষজন বাড়িতে ভিড় কইরো না তোমরা। যে যার যার বাড়ি যাও।" সবাইকে তারা দিল রহিম বক্স। এতক্ষণ যারা বসে তামাশা দেখছিল ছেলে বুড়ো, তারা ধীরে ধীরে বের হয়ে যেতে লাগল। কিছু অতি উৎসাহী লোক তখনও থায় দাঁড়িয়ে রইল। তাদের তামাশা দেখা তখনও শেষ হয়নি। 
"আমি গঞ্জে যাওয়ার সময় সখিনার বাড়িতে খোঁজ নিয়ে যাব। দেখি কিছু জানতে পারি কিনা।" সখিনা মিলিটারির সৎ বোন।
আজকে একটু সকাল-সকাল বাড়ি ফিরল রহিম বক্স হাতে করে কিছুই আনেনি সে আজ। ছোট ছেলেটা তার হাতের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। রহিম বক্স ওর চোখের ভাষাটা পড়তে পারল।
"ছোট্টুর মা দেশের অবস্থা ভালো না। আজকের পর থেকে গঞ্জ আর যাওয়া হইবো না। ঘরে চাইল ডাইল কি আছে।"
"কি বলেন ছোট্টুর বাপ" রহিম বক্স এর বউ বলল। "গঞ্জে যাইবেন না মানে। আর দেশের কি হইছে?"
"কি হইসে তা তো জানি না, তয় খারাপ কিছু একটা হইছে। ঘরে যা আছে তা দিয়ে চলবে তো আমাদের?" 
"ঘরে তো চাইল বেশি নাই। এক সপ্তাহ যাইব কিনা সন্দেহ আছে।" রহিম বক্স কোন উত্তর করল না। আপন মনে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল। একটু দূরে ছোট্টু মেঝেতে বসে ছিল। মেজোটার দিকে একবার তাকালো। বল বোধ হয় আর তাদের কপালে জুটলো না। 
"বুঝলা ছোট্টুর মা" রহিম বক্স বলে চলল। "মিলিটারির মায়ের কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। আমি আসার সময় সখিনাদের বাড়িতে গেছিলাম। ওরা বাড়িতে নাই। সপ্তাহখানেক আগে চইলা গেছে। কই গেছে কেউ জানে না।
"হু, কি যে হইলো বুড়ির" ছোট্টর মা বলল "মিলিটারি তো সারাদিন ধইরা কানতাছে। ওরে কেউ থামাইতে পারতেছে না। মিলিটারির ভাইয়ের বউ বাপের বাড়ি চলে গেছে। কি যে হইলো, কোথায় যে চইলা গেল বুড়ি কাউরে কিছু না বইলা।"
"মিলিটারির ভাইয়ের বউয়ের মুখতো ভালো না। ও গেছে ভালো হইছে।" রহিম বক্স বলল।
হঠাৎ বাইরে কিছু একটা শব্দ পেল রহিম বক্স। শব্দটা বেশ জোরেই হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কেউ হেচরে হেঁটে বেড়াচ্ছে উঠোনে। 
"কিসের শব্দ গো ছোট্টুর মা?" রহিম বক্স জিজ্ঞেস করল।
"বাজান আমি দেখে আসি।" ছোট্টু বলল।
"খবরদার ঘর থেকে বাইরে বেরোবি না। এখন দিনকাল ভালো না।"
"বাজান আমরা কালকেও বাড়ির আশেপাশে এরকম একটা শব্দ পাইছি।" মেজোটা বাপকে জানাল। "শিয়ালের উৎপাত বেশিই বাইড়া গেছে।" রহিম বক্স আপন মনে বলল। "দিনকাল আসলে খারাপ হয়ে গেছে পশুপাখিরাও অস্থির হয়ে পড়ছে।"
পর্ব ৩ পরদিন ভোর। মিন্টুর বাড়িতে গ্রামের মানুষের ভিড়। মিন্টু ঘরের সিঁড়িতে বসে ডুকরে কাঁদছে। গ্রামের কয়েকজন মুরুব্বি তাকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছে। "আমি মায়ের জন্য কিছুই করতে পারলাম না" কাঁপতে কাঁপতে অস্পষ্ট স্বরে বলল মিন্টু। "মা আমার এক গ্লাস পানি খাইতে চাইছিল। আমি পানি আনতে আনতে… " মিন্টু আর কিছু বলতে পারল না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। তারপর আহাজারি করতে থাকলো। "মা আমার চইলা গেছে চইলা গেছে আমারারে ছাইড়া।" উঠোনে রাখা খাটিয়াতে মিন্টুর মায়ের লাশ। সবাই এখন লাশ নিয়ে যাবে কবরস্থানে। জোয়ান মত চারজন ছেলে খাটিয়াটা কাঁধে করে উঠে দাঁড়ালো। মিন্টু সটাং করে সিঁড়ি থেকে উঠে পরলো। একজনকে জোয়ানকে সরিয়ে খাঁটিয়ার একটি হাতল ধরল। অন্য হাতে নিজের চোখের পানি মুছলো। সামসু মিন্টুকে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু মিন্টুর এ আহাজারি থামার নয়। মায়ের দাফন সেরে সামসু আর হাশেম মিন্টুকে দুই পাশ থেকে ধরে ধরে বাড়ির পথে নিয়ে আসছিল। পথে মিন্টু বারবার বসে পড়ছিল আর আহাজারি করে প্রলাপ বকছিলো। "আমি ঢাকা শহর থেকে আসার সময় এই বিদেশি রোগ নিয়ে আসছি। আজকে আমার কারণে আমার মা মারা গেল।" "মিন্টু ভাই উঠো।" সামসু মিন্টুকে উঠানোর চেষ্টা করল। "তোমার শরীরটা ভালো নাই। এরকম করলে তুমি আরো অসুস্থ হয়ে পড়বা।" মিন্টু কে বোঝানোর চেষ্টা করলো সে। "তাছাড়া চাচির অনেক বয়স হয়ছিল" "না তোমরা জানো না আমি ঢাকা থেকে এই মরণ রোগ নিয়া আসছি" মিন্টু চিতকার করে বলতে লাগলো। "মিন্টু ভাই এখন একটু থামো।" হাসেম ওকে থামানোর চেষ্টা করল। "তুমি এরকম করতে থাকলে মানুষ কী মনে করবো।" এবার মিন্টু একটু যেন ঠান্ডা হল। আর কোন কথা বলল না বাকি পথ। সামসু আর হাশেম মিন্টুকে বাড়ি পৌঁছে দিলো। জানিয়ে রাখল ওরা আবার সন্ধ্যার সময় দেখতে আসবে। পথে সামসু আর হাসেম নিজেরা কিছু একটা নিয়ে বলাবলি করতে লাগল। "মিন্টু ভাই যে বিদেশি রোগটার কথা বলতেছে তার কি সেই রোগটাই হইছে নাকি। তারে দেখে তো অসুস্থ লাগতেছিল।" হাসেম বলল। "আমি নিজেও বুঝবার পারতেছি না।" সামসু চিন্তিত। "আমরার গ্রামে তো এই রোগ সম্পর্কে কেউ কিছুই জানে না আর হঠাৎ করে মিন্টুর মা কেনইবা মারা গেল, তার বয়স হইছে ঠিক আছে কিন্তু সেতো সুস্থ-সবলই ছিল।" "রোগটা আবার ছোঁয়াচে ধরনের নাতো?" হাসেম একটু চিন্তিত। "আরে না কি যে কস?" সামসু মানতে পারল না। "বিদেশি রোগ, বিদেশিগোর হয়।" "তাইলে শহরের মানুষের হইল কেমনে?" হাসুর প্রশ্ন। "হুম, চিন্তার কথা।" "হইতে তো পারে, যক্ষা কলেরার মত হইতে পারে না?" সামসু কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। "হুম তা তো হইবার পারে কাশি দিয়া বা খাবার দিয়া ছড়াইতে পারে। কিন্তু আমি মিন্টুরেতো কাশতে দেখি নাই।" "কি জানি ভাই বুঝবার পারতাছিনা।" হাসেম ভ্রু কুচকালো। "মিন্টু ভাই আমাদের গ্রামের বড় ভাই তার বিপদাপদে তারে সাহায্য না করলে হয়।" শামসু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। "হুম, তা তো ঠিক।" রহিম বক্স রহমানের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলো। "চাচা গঞ্জ তো বন্ধ হয়ে গেল।" বলল সে। "হ, আমিও শুনছি। আমার দোকান চালামু কেমনে বুঝবার পারতেছিনা। দোকানের মাল শেষ হয়ে যাবার পথে।" রহমান উত্তর  দিল। "আমার বাসায় ও চাইল ডাইল নাই। আচ্ছা ঢাকা শহরে কি যুদ্ধ লাগছে নাকি?" রহিম বক্স জিজ্ঞেস করল। "মনে তো হয়। আর ওই সব রোগ-শোক কিছু না সরকার যুদ্ধ ঢাকতে মানুষরে এইসব বলতেছে।" রহমান চাচা নিজের থিওরি দিল। যেরকম সে সব সময় দেয়। হাজার ধরনের লোক তার দোকানে আড্ডা দেয়। তাই সমন্বয়ে সে বেশ ওস্তাদ। "আমার কেন জানি মনে হয় সত্যি সত্যি কোন বিদেশি রোগ হানা দিছে।" রহিম বক্স বলল। পাশের গ্রামের টুটপাড়ার অন্য একটা লোক দোকানের ওপাশে বসে ছিল। লোকটাকে রহিম বক্স চেনে। চেহারায় চেনে, নাম জানে না। সম্ভবত শরীফ দেওয়ানের ছেলে। সে একটু শিক্ষিত ধরনের। "আরে ওসব রোগ-শোক কিছু না, আসল কথা হইলো দেশে যুদ্ধ লাগছে। ওই চেহারা চেনা লোকটা বলল। রহিম বক্স কোন উত্তর করল না। রহমান ওই লোকটার সাথে সায় দিলো। বলল, "আমারও তাই মনে হয়। প্রথম থেকেই আমার এরকম একটা কিছু সন্দেহ হইছে।" রহিম বক্স কোন কথা বলল না। চুপ করে শুনল। "চাচা মিন্টুর মা নাকি মারা গেছে?" এবার প্রসঙ্গ পাল্টালো সে। "হ, সকালে দাফনে গেছিলাম।" রহমান উত্তর দিল। "কি হয়েছিল জানো কিছু?" রহিম বক্স জিজ্ঞেস করল। "বয়স হয়েছিল, তাই মারা গেছে।" ওপাশের বেঞ্চে বসা শহীদ দেওয়ানের ছেলে বলল। "শরীর ভালো ছিল না বুড়ির।" রহমান যোগ করল। "আচ্ছা ঢাকা থেকে কোন রোগ বাধায় আসেনাই তো মিন্টু?" হটাত করেই মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেলল রহিম বক্স। বলেই বুঝতে পারল বলাটা ঠিক হয়নি। ও পাশের শিক্ষিত লোকটা সাথে সাথেই খেকিয়ে উঠলো, "আরে না মিয়া, কোন রোগ-শোক না। কইলাম না তোমারে যুদ্ধ বাঁধছে দেশে। দেইখো কয়দিন পর গেরামে মিলিটারি আসবো।" রহিম বক্স কোন উত্তর করল না। তবে রহমান চাচার চেহারায় স্পষ্ট ভয়ের ছাপ দেখতে পেল সে। "এক যুদ্ধ দেখছি জোয়ান বয়সে আর যুদ্ধ দেখতে চাই না।" ভয়ার্ত কন্ঠে রহমান চাচা বলল। চায়ের কাপটা রেখে বেঞ্চ ছেরে উঠে দাঁড়ালো রহিম বক্স। আর কথা বাড়ালো না। বাড়ির পথে হাঁটা দিল। রহিম বক্স এর মনটা ভালো নেই। একা একা পথ চলছে সে। এই গ্রামে মানুষজন এমনি কম। এখন মনে হয় মানুষ আরো কমে গেছে। সবার মনের ভেতর একটা চাপা আতঙ্ক। অনিশ্চয়তার, অজানার। চারিদিকে গুজব। একটা গুমোট ভাব। সত্যি সত্যি কি তবে দেশে যুদ্ধ বেধে গেল। মূর্খ লোকদের জীবনে অনেক কষ্ট। কোন কিছু জানার বোঝার উপায় নাই। গ্রামের কেউ পেপার পত্রিকা পড়ে না। টিভি তো অনেক পরের কথা। বিদ্যুৎ এই গ্রামে আসে নাই। এখনো যাদেরকে গ্রামের মানুষ কিছুটা শিক্ষিত বলে মনে করে তাদের অনেকেই ভবিষ্যতের ব্যাপারে কোন ব্যাখ্যা দিতে পারে না। কেউ কেউ গুজব রটিয়ে বেড়ায়। আর কেউ কেউ ঘর থেকেই বের হয় না। হঠাৎ রাস্তা থেকে নিচে একটু দূরে একটা ক্ষেতের কিনারা ধরে কেউ একজন বসে আছে বলে মনে হলো রহিম বক্স এর। বয়স্ক মতো এক বুড়ি মহিলা। উল্টো দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে তার চেহারা রহিম বক্স দেখতে পারছেনা। একটু অবাক হল রহিম বক্স। একটু পরেই সূর্য ডুবে যাবে, অন্ধকারের চাদর নেমে আসবে পৃথিবীর উপর। এরকম একটা সময় বাড়ির বয়স্ক মানুষ এরকম ক্ষেতের মাঝে বসে থাকার কথা নয়। যেখানে দেশের অবস্থা এখন ভালো নয়। ব্যাপারটা রহিম বক্স এর নিকট খুব একটা ভালো ঠেকলো না। কিন্তু একগুঁয়ে রহিম বক্স সচরাচর অন্যের ব্যাপারে খুব একটা নাক গলায় না। তবুও একবার ভাবল সে ডাক দিবে তাকে কিন্তু পরে কিছু একটা ভেবে মুখ ঘুরিয়ে নিল। বাড়ির পথে হেটে চলল। কিছুদূর আসার পর হটাত তার মিলিটারির মায়ের কথা মনে পড়ল। সাথে সাথেই মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল কিন্তু আশ্চর্য আইলে বসা সেই এখন মানুষটি আর নেই। মুহুর্তেই উধাও হয়ে গেছে। পূর্ণিমার রাত। উঠোনে বসে আছে মিলিটারি আর সিঁড়ির উপর বসে আছে তার ছোট ভাই কালাম। "কাল আমেনারে আনতে যাব।" কালাম মিলিটারির উদ্দেশ্যে বললো। মিলিটারি কোন উত্তর করল না। "মিয়া ভাই, তুমিতো মেম্বরের কাছে গেছিলা আজকে, মেম্বার কি কইলো?" মিলিটারি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল "তারা তো শুধু আশ্বাস দেয়, কাজের কাজ কিছুই করে না।" "আমি এখনো বুঝবার পারতেছিনা পায়খানার ভেতর থেকে মায় কোথায় হারায় গেল? আচ্ছা মিয়া ভাই, তুমি ঠিক দেখছ তো?" কথাটা শুনার সাথে সাথে মিলিটারি চটে গেল। "সবাই আমারে এই একটা প্রশ্ন আর করিস না তো।" উচ্চস্বরে বলল সে, "আমার আর এইটা শুনতে ভালো লাগে না।" "না মানে আমি বলতেছিলাম তুমি ঘুমায় পড়ো নাই তো?" ছোট ভাই আমতা আমতা করে বললো। মিলিটারি কোন উত্তর করল না। ছোট ভাই সম্ভবত ওর মনের অবস্থা বুঝতে পারছিল। সে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। "কই যাইতে পারে মায়" আপন মনে বিড়বিড় করে বলল। "হারায় গিয়ে থাকলে মানুষকে আর ফেরত পাওয়া যায় না?" "ফেরত পাওয়া যাইবো না কেন? নিশ্চয়ই খুঁইজা পাওয়া যাবে। যেখানেই থাকুক, আমি তারে খুঁজে বার করমু।" মিলিটারির কন্ঠে প্রতিজ্ঞা। "তুমি তো আজকে পূব পাড়ায় গেছিলা" কালাম জিজ্ঞেস করল। "হুম গেছিলাম কিন্তু কেউ কোন খোঁজ দিতে পারল না। কালকে টুটপাড়ায় যামু।" বলল মিলিটারি। "মানুষজন কিসের যেন একটা ভয়ে আছে। ঠিকমত দেখা করতে চায় না। বাড়িতে বসবার দিতে চায় না।" "হ, বুঝছি মানুষ বিদেশি রোগের ভয় পায়। আমরা দেশে তো বিদেশ থেকে কেউ আসে নাই ভয় কেন পাবে?" কালাম বলল। "তারপরেও ভাই ভয় তো লাগে সবার। গঞ্জ বন্ধ কইরা দিছে। সবাই কানাঘুষা করতাছে, দেশের সরকার নাকি সবাইরে ঘরে থাকতে কইছে।" মিলিটারি উত্তর দিল। "হ আন্দাজ তো করতে পারতাছি কিছু একটা তো ঘটছে দেশে।" "কিছু না ঘটলে তো সরকার সবকিছু বন্ধ করে দেয় না, মানুষজনেরে দেশে ফেরত যেতে কয় না।" মিলিটারি কিছু আঁচ করতে পারছিল। সন্ধ্যের পর। রহিম বক্স এর বাড়ির উঠোনে। "ভাই সেই কবে টিভি দেখছিলাম সবুর দেওয়ানের বাড়িতে গিয়া।" ছোট্টু বলল মেজোকে। "হ তারপরে তো ওদের টিভিটাই নষ্ট হয়ে গেল। আহারে এখনো চোখের মধ্যে ভাসে, সার্কাসের সেই বাঘ, বাঘের হুংকার। আগুনের গোলকের ভেতর দিয়া সিংহের লাফ। আর জীবনে কোনদিন কি টিভি দেখতে পারমু?" একটু দূরে ক্ষেতের আইল ধরে কালু বাসায় ফিরছিল। কালুকে দেখে ছোট্ট একটা ডাক ছাড়লো। তারপর মেজোকে উদ্দেশ্য করে বলল "দিনকাল কত খারাপ তার ওপর হেই সূর্য ডোবার পরে বাসায় ফিরেতেসে। আজকে বাজানের কাছে যদি বিচার না দিছি।" মেজটা তাকিয়ে ছিল কালুর দিকে। অন্ধকারে ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা। তবে হাঁটার ধরন দেখে ও বুঝতে পারল এটা কালুই। "ঠিকই বলছ ভাই বেশি সাহস হয়ে গেসে। হঠাৎ ভেতর থেকে মায়ের কন্ঠ, "সোহেল কান্নাকাটি করতেছে। ছোট্টু ওরে একটু ধর।" সোহেল সবার ছোটটা হাটি হাটি পা পা পা করে এখন দৌড়ায়৷ ছোট্টু দৌড়ে ঘরের ভেতর গেল। ছোটটার যে কি হয়েছে সারাদিন রাত অস্থিরতা করে। মেজোর  মনোযোগ  ঘরের দিকে চলে গি���়েছিল। কান্না থামার পরে মাথা ঘুরিয়ে ক্ষেতের আইলের দিকে তাকালো। কালুর এতক্ষণে বাড়ির কাছাকাছি চলে আসার কথা। কিন্তু সে কালুকে দেখতে পেল না। মেজো উঠে দাঁড়ালো। ডানে বামে তাকাল কিন্তু তারপরেও কালুকে দেখতে পেল না। কিছুক্ষণ ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে রইল সে। তারপর ঘরে গেল। "মা কালুকে ঘরে ঢুকতে দেখসো।" সে জিজ্ঞেস করল। "কই নাতো। কালুতো এখনো বাড়ি ফেরে নাই।" মেজোর কাছে একটু খটকা লাগলো। সে আবার বাইরে বেরিয়ে এলো। কালু কি আবার ফিরে গেছে। করিম বক্স মিলিটারি সাথে দেখা শেষ করে বাড়ির পথে রওনা দিল। মিলিটারির বাড়ি থেকে তার বাড়ি বেশি দূরে নয়। কিছুদূর হাটার পর বাড়ির কাছাকাছি আসতেই চেঁচামেচি শুনে দৌড়ে গেল বাড়ির ভেতর। "কি হইছে তোমরা কালু কালু বলে চিৎকার করতেছো কেন?" বউকে জিজ্ঞেস করল সে। "কালু এখনো ঘরে ফেরে নাই।" রহিম বক্স এর বউ উত্তর দিল। "কি বলো রাইত নাইমা গেসে তো অনেকক্ষণ হইল। এখন ঘরে ফেরে নাই মানে?" রহিম বক্সের ��ুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো। এই গ্রামে মানুষ মারা যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে তার ছেলে বাড়ি ফেরে নাই। কালু অনেক দুষ্টু। মাঝে মাঝে দেরি করে বাড়ি ফেরে। এর জন্য অনেক মার খেয়েছে সে কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি। সেজন্য রহিম বক্স ওকে মারা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু এরকম দিনে এত করে বোঝানোর পরেও সে বাড়ি ফেরে নাই, এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে এটা রহিম বক্স ঠিক মেনে নিতে পারছে না। তার মনের ভেতর অজানা এক শঙ্কা ভর করছে। হতে পারে তার ছেলে দুষ্ট, গোয়ার ধরনের কিন্তু এতো দেরী করে বাড়ি ফেরার পাত্র সে নয়। কেন যেন রহিম বক্স এর বুকটা ভারী হয়ে আসছে। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে। "আমি যাচ্ছি ওকে খুঁজে নিয়ে আসি।" এই বলে ঘর থেকে একটা টর্চ নিয়ে বেরিয়ে পরলো সে। বাড়ি থেকে ছোট্টু চিল্লিয়ে বলল "বাজান আমি আসমু তোমার সাথে?" "না। তুই মায়ের সাথে থাক।" রহিম বক্স উত্তর করলো।
পর্ব ৪ অন্ধকারে ধান ক্ষেতের আইল ধরে হনহন করে হেঁটে চলছে রহিম বক্স। কালুকে তার খুঁজে বের করতেই হবে। দেশের যা অবস্থা, কখন কি ঘটে যায় বলা মুশকিল। রহিম বক্স জানে তার এই ছেলেটা খুব দুষ্টু প্রকৃতির। সন্ধ্যা হয়ে গেলেও তার বাড়িতে আসতে মন চায় না। মাছ ধরা কালুর নেশা। মাঝেমধ্যেই রাত্রিতে খেতের মাঝে ছোট মাছ ধরায় নেমে পড়ে সে। এই নেশায় কখনো কখনো সে বাড়িতে ফেরার কথাই ভুলে যায়। বহুবার এরকম হয়েছে রহিম বক্স লাঠি পেটা করে কালুকে ক্ষেতের কাদামাটি থেকে তুলে বাড়ি নিয়ে এসেছে। আজকেও কালু কিছু একটা সেরকমই করবে বলে ধরে নিয়েছে রহিম বক্স। দক্ষিণের মিলিটারিদের বাড়ির পাশে বড় খেতে মাছের আনাগোনা বেশি। কালু ওই দিকটায় যেতে পারে। রহিম বক্স সেই দিকেই এগোচ্ছিল। মাঝেমধ্যে দূরে খেকশিয়ালের দুই একটা হাক ছাড়া আশেপাশে আর কোন সাড়া শব্দ নেই। নিস্তব্ধতার এই গ্রাম যেন এই রাতে শ্মশানের মতো নীরব হয়ে পড়েছে। রহিম বক্স টর্চ জ্বেলে মাঝে মাঝে দূরে আলো ফেলছিল আর দুই-একবার কালুর নাম ধরে ডাক ছাড়ছিল। কিন্তু কালুর তো কোন হদিসই নেই। হঠাৎ একটু দূরে এক ধরনের খচমচ শব্দ শুনতে পেল রহিম বক্স। শব্দটা সম্ভবত পাশের ক্ষেতের ওপাশের আইল থেকে আসছিল। রহিম বক্স টর্চ এর আলো ফেলে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করল। 'কালু' বলে আবারো হাঁক ছাড়লো। একটু সামনে এগিয়ে হাতের ডানে মোর নিতেই মনে হল কাদামাটিতে কেউ কিছু একটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে। যদিও উচু ধান গাছগুলির কারণে তেমন কিছু দেখতে পেল না সে। যতই এগোচ্ছিল সেই শব্দটা যেন তার থেকে থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। এবার একটু ছোট ছোট পদক্ষেপে দৌড়াতে শুরু করলো রহিম বক্স। ডানপাশের ক্ষেতের আইলে পৌঁছাতে যা দেখতে পেল তাতে কিছুটা অবাকই হল সে। কেউ একজন কাদা মাটির মধ্যে ছোট একটা গর্তের মতো তৈরি করে ফেলেছে। রহিম বক্স এর চেহারায় কিছুটা চিন্তার ভাঁজ পড়ল। এসব কী কালু করছে! রাত বিরাতে ক্ষেতের আইলে গর্ত খুঁড়তে যাবে কে? রহিম বক্স টর্চের আলো দিয়ে আশেপাশটা ভাল করে আরেকবার দেখার চেষ্টা করল। প্রথমে তার কাছে মনে হচ্ছিলো গর্তটা কোন শেয়াল কুকুর জাতীয় প্রাণী খুঁড়ছে। কিন্তু ভালো করে আলো ফেলে একটা ব্যাপারটা লক্ষ্য করল সে। গর্তটা কোন মানুষ খোড়ার করার চেষ্টা করেছে। পাচ আংগুলের দাগ রয়েছে সেখানে। রহিম বক্স তার আশেপাশে একবার দেখলো। এবার একটু জোরেই চেচিয়ে ডাকলো কালুকে। কয়েক মুহূর্ত পর হঠাৎ করেই তার থেকে কিছুটা দূরে এক ধরনের গোঙানির মতো গরগর শব্দ পেল। এবার যেন একটু আঁতকে উঠল রহিম বক্স। এটা কোন মানুষের শব্দ, শিয়াল কুকুরের নয়! তবে এটা কালুও নয়! শব্দটার ভেতরে কোথায় যেন এক ধরনের হিংস্রতা লুকিয়ে আছে। মনে হচ্ছিলো কেউ দুমড়ে মুচরে কিছু একটা গো গ্রাসে গিলছে, তারপর মুখ হা করে শ্বাস নিচ্ছে। এক ধরনের টানাহেঁচড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। এই প্রথমবারের মতো রহিম বক্সের ভেতরে এক ধরনের ভয় কাজ করতে শুরু করলো। কিছুটা আতঙ্কিত রহিম বক্স এবার ছোট ছোট পদক্ষেপে শব্দের উৎস খুঁজে বের করার চেষ্টা করলো। শত হোক তার ছেলেকে তো খুঁজে বের করতে হবে। এই শব্দের সাথে না আবার তার ছেলের কোন সম্পর্ক রয়েছে। অজানা আশঙ্কায় তার বুকটা একবার কেঁপে উঠলো। বাম পাশের আইল ধরে সামনের দিকে এগিয়ে চলল সে। লক্ষ্য করল এবার শব্দটা তার থেকে একটা ক্ষেত পরে গিয়ে তৈরি হচ্ছে। অনেকটা মিলিটারিদের বাড়ির পাশ ঘেঁষে, ক্ষেতের ওপাশটায়। তার কাছে মনে হল উৎসের মালিক ইচ্ছে করেই তার কাছ থেকে দূরে দূরে সরে যাচ্ছে। তাকে নজরে রাখছে। আতঙ্কের একটা হিম শীতল স্রোত তার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। ভয় কাটানোর জন্য ধমকের সুরে বলে উঠল, "কে ওখান? আমার সাথে মশকরা! এত বড় সাহস?" কোন সারাশব্দ এলো না। কালুর তো বটেই, গ্রামের কারো এতো বড় বুকের পাটা হয়নি যে রহিম বক্স এর সাথে মশকরা করবে। সবাই জানে রহিম বক্স রগচটা বদমেজাজী ধরনের লোক। আরো কিছুদূর এগোনোর পর একটু দূরে অন্ধকারে এবার কিছু একটা যেন দেখতে পেল রহিম বক্স। মাটি খুঁড়েই চলছে একটি অবয়ব। "কে ওখানে?" কোন উত্তর এল না। রহিম বক্স আবার জিজ্ঞেস করল। তাও কোন সাড়াশব্দ নেই। অবয়বটা মাটি খুড়ে কিছু একটা পুতে রাখার চেষ্টা করছে। রহিম বক্স টর্চের আলো সোজা মানুষটার চেহারার উপর ফেলল। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো বয়স্ক খুনোখুনে বুড়ি মতো এক মহিলা বসে আছে সেখানে। অনবরত মাটি খুঁড়ে চলছে। হাতগুলো শীর্ণ। গায়ে সাদা রঙের এক ধরনের কাপড়, কাদামাটিতে সেটা ভিজে সিক্ত। ভালো করে খেয়াল করলে সে বুঝতে পারলো কাপরটি এক ধরনের কাফনের কাপড়। বুড়িটা হঠাৎ করেই তার দিকে মুখ ঘোরাল। উজ্জল টর্চের আলোয় সে যার চেহারা দেখতে পেল তাতে তার শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের স্রোত নেমে গেল। এটা যে মিন্টুর মা! গতকালই দাফন হয়েছে যার। পর্ব ৫ রহিম বক্স ছুটছে। ছুটছে তো ছুটছে। কাদা মাটি সবকিছু উপেক্ষা করে প্রাণপনে ছুটে চলছে। এ যেন এক দুঃস্বপ্নের রাত তার জীবনে। ক্ষণে ক্ষণে তারে মনে হচ্ছে যেন কোন ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখছে সে। রহিম বক্সের বুক থেকে এক ধরনের বোবাকান্না বের হয়ে আসে। তার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আর কতক্ষন এভাবে দৌড়াবে সে জানে না। মনে দুঃখ, ক্ষোভ নিয়ে দৌড়ে চলছে সে। কী ঘটে যাচ্ছে তার চারিপাশে। কি হচ্ছে এই গ্রাম ঘিরে। এটা কি প্রলয়ের আলামত! গতকালই যে মানুষের দাফন কর্ম শেষ করে এসেছে, আজ সেই মানুষের লাশের মুখোমুখি হতে হবে। রহিম বক্সের কল্পনাতেও এরকম বীভৎস বিভীষিকাময় কোন চিন্তার উদ্রেক হয়নি। আজ সে যা দেখেছে সেটা যে তার বোধ শক্তি, চিন্তাশক্তি লোপ করে দিল। তার পিছনে ধাওয়া করছে একটি লাশ! যে লাশটিকে সে একটু আগে তার ছেলের মস্তক গলদঘর্ম করতে দেখেছে! এমন ভয়ঙ্কর দৃশ্য কোনদিন কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি রহিম বক্স। আর সেটা পারবেও না! অবশ্য আজ রাত্রির পর যদি ��ে বেঁচে থাকে। রহিম বক্স এর মাথা থেকে তার ছেলের মায়া উঠে গেছে। এই মুহূর্তে সে নিজের জান বাঁচানোর জন্য প্রানপনে দৌড়ে চলছে। নিজের ছেলের জানের মায়া ছেড়ে দিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য এভাবে দৌড়াতে হবে সেটাও রহিম বক্স ভাবতে পারছে না। কিন্তু তার পিছনে যে বিকট অপার্থিব চিৎকার। কেউ তার দিকে ছুটে আসছে। রহিম বক্স আর পেছনে তাকানোর সাহস পেল না। তার যে শুধুই মনে হচ্ছিল পেছনের শব্দটি একটু একটু করে আরও কাছাকাছি চলে আসছে। একটু পরেই হয়তো কেউ তার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলবে। যথেষ্ট জওয়ান আর স্বাস্থবান লোক রহিম বক্স। পেটা শরীর তার। তারপরেও এই ভয়ঙ্কর প্রাণীর সাথে সে যে কোন রকমে পেরে উঠছে না! পরদিন সকাল। মিলিটারি উঠোনে নিম গাছের ডাল দিয়ে দাঁত মাঝছিল। তার ছোট ভাই পায়খানা থেকে হাতে করে একটি বদনা নিয়ে ফিরছিল। মিলিটারি দাঁত মাজতে মাজতে তার ভাইয়ের দিকে ফিরে তাকাল। বলল, কাল রাইতে বাইরে কোন হট্টগোল হইছিল? কালাম বদনাটা উঠোনের এক কোনায় রেখে বলল, হইতে পারে। আমি রাইতে কারো চিৎকারের শব্দ পাইছিলাম। আমারার বাড়ি থাইকে কিছুটা দুরে। আমার কানেও আইছে। কারো বাড়ি কি ডাকাত পরছিল নাকি? কী যে কও? ডাকাত পরবো কোথা থাইকা? দেখি আইজ দেওয়ান বাড়ি গেলে লোকজনরে জিগামুনে। কালাম উত্তর দিল। মিলিটারি দাঁত মাজতে মাজতে হঠাৎ লক্ষ করল তার দাঁতের কোনা দিয়ে একটু রক্ত বেরোচ্ছে। সে গলায় একটু পানি নিয়ে কুলকুচি করে উঠনে ফেলল। দাঁত বেশি মাজতে গিয়ে নিম গাছের শলাকা ঢুকে তার মারি কেটে গেছে। দেওয়ান বাড়িতে গ্রামের সব লোকজন নিয়ে বিরাট বৈঠক বসেছে। গ্রামের আকবর মেম্বর সেই বৈঠকের সঞ্চালক। টুটপাড়া, পূবপাড়া সহ আশেপাশের গ্রামের সব লোকজন জড়ো হয়েছে। আকবর মেম্বর একটু গলা কেশে নিল। তারপর বলতে শুরু করল, ভাইসব, আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং করবার জন্য তোমাগো সকলরে ডাকা হইছে। তোমরা তো সবাই জানো ঢাকা শহরে একটা ছোঁয়াছে রোগ ছড়ায় পড়ছে। একদল বিদেশী রোগটা নিয়া প্রথমে ঢাকা শহরে আইসে। তারপর সেইটা বিভিন্ন মানুষের মধ্যে দেখা দিসে। যদ্দুর শুনছি রোগটা খুব জটিল বয়স্ক মানুষজনের জন্য। আক্রান্ত হলে তারা মারাও যাইবার পারে। একটা দীর্ঘশ্বাস নিল আকবর মেম্বার তারপর বলে চলল, এই যেমন মিন্টু ঢাকা ছাইড়া আইছে, তার দুইদিন পরে তার মায় মারা গেছে। আমারার ধারণা মিন্টু ঢাকা শহর থাইকা এই রোগ সাথে নিয়া আইছে। এবার একটু গলা কেশে নিলো আকবর মেম্বার। তারপর একটু ধমকের সুরে বলল, শোনো মিয়ারা, যারা গ্রামের বাইরে থাইকা গ্রামে ঢুকছে, তাদের সবার সাথে আইজ হইতে গ্রামের সবার দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ। সবুর দেওয়ান কথার মাঝে বলে উঠল, আমার তো মনে হয় ঢাকা শহরে যুদ্ধ লাগছে। হইবার পারে। মেম্বর একটু বিরক্তির স্বরে বলল। যাই হোক, আমরা সবাই আগামী এক মাস মিন্টুরে একঘরে কইরা রাখার সিদ্ধান্ত নিসি। আর যারা যারা মিন্টুর বাড়িতে গেছিলা, মিন্টুর মায়ের জানাজায় অংশগ্রহণ করছো, তারা সবাইও এক ঘরে হইয়া থাকবা। এক মাসের জন্য ঘর থেকে বাইর হইবা না। তোমাগো খাওন-দাওন যা লাগবো আমরা বাড়িতে পৌঁছায় দিমু। ভিড়ের ভেতরে মানুষের ফিসফিস বেড়ে গেল। ফিসফিসানি বন্ধ করতে আকবর মেম্বার বলল, এই সিদ্ধান্ত আমরার গ্রামবাসীর মঙ্গলের জন্য। আর এইটা আমার বানানো কোন বিষয় না। সরকারের পক্ষ থাইকা সন্দেহভাজন লোকদের এক মাস আলাদা কইরা রাখবার কথা বলা হয়েছে। আকবর মেম্বার একটু থামল তারপর ভিড়ের মধ্যে কাউকে খোঁজার চেষ্টা করলো। সামসু হাসেম তোমরা সামনে আসো। বলল সে। সামসু আর হাসেম একে অপরের দিকে তাকালো। তারপর ভিড় ঠেলে সামনে বের হয়ে এলো। হারিস দেওয়ান বলল, তোমরা একটু পাশে সইরা দাঁড়াও মিয়ারা। সামসু আর হাশেম ভিড় থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়ালো। হারিস দেওয়ান সবুর দেওয়ানের বাবা। তোমরা তো মিন্টুর সাথে দেখা করতে গেছিলা। আকবর মেম্বার বলল। হ, গেছিলাম। শামসু উত্তর দিলো। ওরে তোমরা কি কেউ হাত দিয়া স্পর্শ করছিলা। সামসু আর হাসেম কোন উত্তর দিল না। যাই হোক, তোমরা দুইজন বাড়ির ভিতর এক ঘরে হইয়া থাকবা, আগামী এক মাস। হাসেম কিছু একটা বলতে গেল। সামসু ওর হাত চেপে ধরল, বলল, যে আচ্ছা। আর যারা যারা তার সাথে তার মায়ের দাফন করতে কবরস্থানে গেসিলা তারাও আজকের দিন থাইকা বাড়ির বাইরে বাইর হইবা না। আগামী এক মাস। এবার আকবর মেম্বার তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিশালদেহী লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল, শফিক তুই এই বিষয়টা নজরে রাখবি। শফিক উচা লম্বা পালোয়ানের মত। ওকে গ্রামের সবাই ভয় পায়। ওর একটা ছোটখাটো গ্যাং আছে যারা  রীতিমত গ্রামে মস্তানি করে বেড়ায়। চাঁদা তুলে। মেম্বর আবার ওদেরকে খুব তোয়াজ করে। হারিস দেওয়ানও ওদেরকে পাল পোষ করে। রহিম বক্স সভায় আসে নাই? হঠাৎ শিক্ষিত সবুর দেওয়ান বলল। ভিড়ের লোকজন একে অপরের দিকে এদিক ওদিক তাঁকালো। রহিম বক্স সেখানে নেই। এই ঘাড় ত্যাড়া লোকটা সারাজীবনেই অসামাজিক ছিল। এখনো আছে। এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ সভায় সে আসে নাইক্কা। সবুর দেওয়ান বলল। রহিম বক্স এর এখনো হুশ ফেরেনি। একবার সে কিছু বলে উঠছিল কিন্তু জড়ানো কন্ঠে কি বলছিল সেটা  তার বউ ঠিক বুঝে উঠতে পারে নাই। রহিম বক্সের পা এ একটা বিরাট আচড় মনে হচ্ছিল। বড় বড় নখরযুক্ত পাঁচ আঙ্গুল দিয়ে কেউ যেন তার পা আচড়ে ধরেছিল।  কালামের বউ একহাতে পাখা নিয়ে রহিম বক্স এর মাথায় উপর বাতাস করছে। আর রহিম বক্স এর বউ তার মাথায় পট্টি দিচ্ছে। বাইরে মিলিটারি আর কালাম এসেছে। ছোট্টু আর মেজোর সাথে কথা বলছে। কাল রাত থাইকা কালুর কোন খোঁজ নাই মিলিটারি চাচা। ছোট্টু বলল। বাজানে কালুরে খুজতে গেছিল। তারপর কি হইছে আমরা কেউ কিছু জানি না। ভোরের দিকে বাজানের চিৎকার শুনে আমরা বাইরে বের হই। বাজান কোন রকমে উঠোনে আইসে পইরা যায়। বলে আমারারে ভেতরে নিয়ে চল। শিগগির ঘরের ভেতরে নিয়া চল। আমরারে মাইরে ফেলবে। এই বলে সে মায়ের হাতের উপরেই পইড়া যায়। আমরা তারে দ্রুত ঘরে নিয়া যাই। মায় ঘরে খিল দেয়। বাকিটা সময় আমরা ঘর থাইকা বাইর হই নাই। কিছু একটা ঘরের বাইরে ওই সময়টা হাঁটাচলা করছে। আমরা ভয়ে আধমরা হই গেছিলাম। মনে হইছে কোন হিংস্র প্রাণী আমরারে খাবার জন্য বাইরে ঘোরাঘুরি করতাছে। ছোটুর সমস্ত চেহারাজুড়ে আতঙ্কের ছাপ। হিংস্র প্রাণী! কালাম বিশ্বাস করতে পারতেছে না। হয়। আমরা ঠিক বুঝবার পারি নাই। আর বাজানের পায়ে তো আচড়ও দিসে। ছোট্টু বলল। এই তল্লাটে তো এক শিয়াল কুকুর ছাড়া আর কোন প্রাণী নাই। তয় কোন পাগলা শিয়াল কুত্তাও আক্রমণ কইরা থাকতে পারে। খোঁজ নিতে হইব। কালাম বলল। কোন শিয়াল কুত্তা পাগল হয়ে গিয়া থাকলে গেরামের বাচ্চা-কাচ্চা বুড়া মানুষ যে কেউ বিপদে পড়বার পারে। মিলিটারি এতক্ষণ চুপ করে ছিল, এবার মুখ খুলল, আমার মনে হয় এটা কোন কুত্তা বিলাই না, আরো শক্তিশালী কিছু। আর পায়ে যে আচর দেখলাম সেটা  পাঁচ নখের। শিয়াল কুত্তার চারটা নখ হয়, পাচটা না। কালামের চেহারায় চিন্তার ভাঁজ। খোদাই জানে আমার মায়ের সাথে কি হইছে। আমার মনে হয় আমাদের সবার আকবর মেম্বার এর কাছে যাওয়া উচিত। তারে বিষয়টা জানানো উচিত। সখিনার বাপ খুব ধার্মিক লোক। সে প্রতিদিনই নামাজের পাটিতে বসে তার ছেলে মেয়ের জন্য কান্নাকাটি করে। আজ প্রায় সপ্তাহখানেক হলো দুজনই নিখোঁজ। সখিনার বাপ সম্ভাব্য সব জায়গায় ওদেরকে খুঁজতে গেছে। বুড়ো মানুষ, গায়ে শক্তি নেই তা না হলে পাশের গ্রামে মিলিটারির বাড়িতে যেতো সে। ছেলে মেয়ে হারিয়ে যাবার পর তাকে দেখা শোনার কেউ নেই। এখন সে তার বোনের বাড়িতে।   এই বুড়ো বয়সে ছেলে মেয়ে খুইয়ে তার অন্তরাত্মার শেষ শান্তিটুকু নষ্ট হয়ে গেছে। মনে অশান্তি রাতে ঘুম নেই। সে ভাবলো একবার হলেও মিলিটারি বাড়িতে যাবে সে। কেন জানি তার ধারনা তার ছেলেমেয়ে সেখানে গিয়ে থাকতে পারে। যদিও তার বোন কোন ভাবেই তাকে সেখানে যেতে দিতে রাজি নয়। মিলিটারিদের সাথে তাদের সম্পর্ক যে অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গেছে।
পর্ব ৬ কালু' বলে চিৎকার করে বিছানায় উঠে বসলো রহিম বক্স। আশেপাশে তাকিয়ে খুঁজতে শুরু করলো কালুকে। তার স্ত্রী ছোট্টু, মেজো সবাই থাকলেও ঘরে কালুকে খুঁজে পেল না সে। খাট থেকে নামতে যাবে তখনই তার ডান পায়ে একটু ব্যথা অনুভব করলো। গোড়ালির উপর থেকে হাটুর নিচ পর্যন্ত সাদা কাপড়ে ব্যান্ডেজ করা তার পা। কোন কিছু তোয়াক্কা না করে বিছানা ছেড়ে নেমে পড়ল রহিম বক্স। খাটের পাশে নিচে মেঝেতে বসা ছিল তার স্ত্রী। একবার তার দিকে তাকিয়ে কি একটা ভেবে এক দৌড়ে উঠোনে চলে গেল সে। হন্তদন্ত হয়ে এদিক সেদিক কিছু একটা খুঁজতে লাগলো। পেছন পেছন তার স্ত্রী উঠনে বেরিয়ে এলো। রহিম বক্স এর অস্থিরতা তার চোখ এড়ালো না। আমরার কালুর কি হইছ? রহিম বক্সের অস্থিরতা দেখে এক অজানা শঙ্কায় তার স্ত্রীর ভেতরটা গ্রাস করল। আঁচলের কাপড় দিয়ে নিজের নাক চোখ মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করল। এবার যেন রহিম বক্সের ভ্রম কাটলো। উঠোনের মাঝখানে হাঁটু গেড়ে বসে পরল সে। তার স্ত্রী দৌড়ে তার কাছে এগিয়ে গেল। বসে জড়িয়ে ধরল তাকে। মাথা নাড়তে নাড়তে নিচু গলায় রহিম বক্স বলল, আমরার কালু নাইরে, কালুর মা! আমরার কালু নাই! … অবশেষে সখিনার বুড়ো বাপ মিলিটারির বাড়ি পৌঁছাতে পারল। মিলিটারি! কালাম! বাড়ি আছোনি? গলা হাঁকিয়ে তাদের ডাকলো বুড়ো। লাঠিতে ভর করে ঠক ঠক শব্দে উঠোনে এসে দাঁড়াল। বুড়োর গলা শুনে ঘরের ভেতর থেকে একটা গেঞ্জি মাথা গলিয়ে গায়ে দিতে দিতে বাইরে বেরিয়ে এলো মিলিটারি, ছোট ভাই কালাম আর পেছন পেছন কালামের বউ। বুড়োকে দেখে কালামের চেহারায় একটু খুশির ছাপ ফুটে উঠল। বলল, কেমন আছেন বাজান? কালাম ও মিলিটারি বুড়োর সৎ ছেলেপেলে। কুঁজো বুড়ির আগের ঘরের ছেলে মেয়ে হল সখিনা ও ইদ্রিস। জোয়ান বয়সে বুড়ো অনেক বেশি অত্যাচার করত তাদের মায়ের উপর। একবার লাঠিপেটা করে তাদের মায়ের কোমরের হাড় ভেঙে দেয় সে। তখনই এই বুড়োকে ছেড়ে চলে আসে কুঁজো বুড়ি। আর এই গ্রামের শহীদ মুন্সির সাথে তার বিয়ে হয়। শহীদ মুন্সী মিলিটারি আর কালামের বাবা। বছরখানেক হলো যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে সে। সৎবাপের উপর এখন আর সেই ক্ষোভ নেই কালামের। কুজোবুড়ি নিজেও তাকে মাফ করে দিয়েছে অনেক আগেই। বুড়ি হারিয়ে যাওয়ার আগে বুড়োর অনেক পুরনো স্মৃতি নিয়ে ছেলেদের সাথে গল্প করত। কালাম বুড়োকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর হু হু করে কেঁদে উঠলো। বলল, আমরার মায়েরে খুঁজে পাইতেছি না, বাজান! ... রহিম বক্স মিলিটারিকে সাথে নিয়ে সন্ধ্যা পাড়ায় কবরস্থানে গেল। সেখানেই মিন্টুর মায়ের লাশ দাফন করা হয়েছে। সকালের দিকে মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে। তাই পুরো কবরস্থান কাদায় সিক্ত। কবরস্থানের আশেপাশে নেই কোনো মানুষজন। জনমানব শূন্য নীরব নিস্তব্ধ চারিদিক। সূর্য প্রায় ডুবুডুবু। আর কিছুক্ষণ পরে আঁধার নেমে আসবে। তাই যা কিছুই করার খুব দ্রুতই করতে হবে তাদের। মিলিটারি আঙ্গুল দিয়ে এক কোনায় একটি কবর নির্দেশ করে দেখালো। মিয়া ভাই, ওই কোনার কবরখানাই! রহিম বক্স মাথা ঘুরিয়ে সেদিকে তাকাল। কাদা মাটির উপর দিয়ে খুব সাবধানে পা ফেলে চলল। দূর থেকে দেখে সবকিছু ঠিকঠাকই মনে হচ্ছিল। মনে মনে প্রার্থনা করলো রহিম বক্স যেন তার শঙ্কা কোনভাবেই সত্যি না হয়। সেদিনকার পুরো ঘটনাটি যেন শুধুই একটি দুঃস্বপ্ন হয়। সতর্ক পদক্ষেপে এক পা দু পা করে এগিয়ে যাচ্ছিল রহিম বক্স। সে জানে এখানে কিছুই পাবে না। একটি সাধারণ স্বাভাবিক কবর ছাড়া আর কিছু থাকবে না। ব্যাপারটিকে এবার বিশ্বাস করতে শুরু করেছে রহিম বক্স। সেদিন তবে কিছুই ঘটেনি। সবই ছিল একটা দুঃস্বপ্ন মাত্র! কবরের একদম সন্নিকটে আসতেই রহিম বক্স এর ভুলটি পুরোপুরি ভেঙে গেল। তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। পুরো কবরটা যে ভেতর থেকে দোমড়ানো মোচড়ানো। এটাকে আর কবর বলার উপায় নেই। একটা উঁচু নিচু ছোটখাটো ডোবা যেন। বৃষ্টির পানি চুইয়ে চুইয়ে ভেতরে পড়ে গর্তটি অনেকখানি ভরে গেছে। আশ্চর্য! এটাতো আর কবরের চেহারায় নেই! মিলিটারি বলে উঠলো। কোন শিয়াল কুকুরের কাজ! চুপ করে রইল রহিম বক্স। কোন উত্তর দিল না। মানসিকভাবে যেন বিপর্যস্ত সে। কিছুতেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তবে সত্যিই সত্যিই ঘটেছে ব্যাপারটা! এই গর্তের ভেতর থেকে কিছু একটা বাইরে বেরিয়ে এসেছে। বাইরে থেকে খোড়া কোন প্রাণী��� গর্ত এটি নয়। রহিম বক্স এর পেটের ভেতরটা কেমন করে উঠলো। কিছু একটা ভেবে যেন গুলিয়ে উঠলো। তারপরই হুরমুর করে সে চারিদিকে বমি করে দিল। মিলিটারি ছুটে তার পাশে গেল। রহিম বক্স হাটু গেড়ে কাদায় বসে পড়ছে। … শফিক তাঁর লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে মিন্টুর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার সাথে থাকা এক সাঙ্গকে ইশারায় মিন্টুকে ডাকার নির্দেশ দিল। মিন্টু ভাই! একটু বাইরে আসো। তোমার জন্য বাজার সদাই নিয়া আইছি। শফিক লাঠিয়াল গটমট করে তার পাশে থাকা সাঙ্গোর দিকে তাকালো। সাঙ্গো কাচুমাচু করে গলা নামিয়ে নিল। শফিকের সামনে একটু জোরেই চিৎকার করে ফেলেছে সে। তাদের একজনের হাতে একটি বড় বাজারের ব্যাগ। আকবর মেম্বর মিন্টুর জন্য এক সপ্তাহের বাজার পাঠিয়েছে। কয়েক মুহূর্ত পর মিন্টুর ঘরের খিল শব্দ করে খুলতে শুরু করল। দরজার একটা কপাট খুলে গলা বাড়িয়ে মিন্টু বলল, কে ওখানে? শফিকের সাঙ্গ উত্তর দিলো, মিন্টু ভাই আমাদের মেম্বার সাব তোমার জন্য বাজার পাঠাইছে। মিন্টু বলল, উঠোনের কোনায় রাইখা যাও। আমি নিয়া নিবো নে। সাঙ্গ একটু আমতা আমতা করে বলল, ওস্তাদ, তোমার সাথে দুইটা কথা কইব। একটু বাইরে আসো। মিন্টু কোন উত্তর দিল না। ঘরের ভিতরে গেল। একটু পরে একটা জামা গায়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। সাঙ্গ বলল, হইছে। ওইখানেই দাড়াও। শফিক ওর সাঙ্গকে এক হাত দিয়ে পেছনে ঠেলে নিজে একটু সামনে এগিয়ে গেল। শফিকের হাতে একটা মোটা চওড়া লাঠি। তার সাঙ্গোপাঙ্গ তাকে আর সামনে যেতে মানা করল, বলল, ওস্তাদ দূরে খাড়াও। অতো সামনে যাইতেছ কেন? শফিক হাতের ইশারায় থামতে বলল ওদের। সঙ্গে সঙ্গেই চুপ মেরে গেল দুজনে। মিন্টুর অনেকটা কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালো শফিক। বলল, তোমার তো ঢাকা ছাইড়া আসা উচিত হয় নাই, মিন্টু। দাত খিটমিট করছিল সে। মিন্টু একটু ইতস্তত করল, তারপর বলল, আমি তো ইচ্ছা কইরা আসি নাই। আমারে ঢাকা ছাইড়া যাইতে বলা হইছে। তোমার কি এমন হয়েছিল যে তোমারে ঢাকা থাইকা গ্রামে পাঠায় দিলো। মিন্টু সাথে সাথে কোন উত্তর দিল না। একটু পরে বললো, আমিতো এখন সুস্থ আছি। পুরোটাই সাইরা উঠছি। শফিক একটু যেন রেগে গেল। বলল, তুমি কি ডাক্তার নাকি? তুমি বুঝলা কেমনে ভালো হইয়া গেছো? পরপরই নিজেকে একটু সামলে নিয়ে কটমটে দৃষ্টিতে বলল, তুমি তো তোমার মায়ের মৃত্যুর কারণ! তুমি যে আরো কত মানুষের মৃত্যুর কারণ হইয়া দাঁড়াইবা, এক খোদাই জানে! ঢাকা থাইকা এই অসুখে তুমি মইরা গেলেও গ্রামবাসী বাইচা যাইতো। এখন তো তুমি নিজেও মরবো বাকি সবাইরে নিয়ে মরবা। আমি তো বলছি মিয়া ভাই, আমি সুস্থ হইয়া গেছি। মিন্টু একটু উত্তেজিত হয়ে পরলো যেন এবার। তোমারে কইলাম না? তুমি কি ডাক্তার হইয়া গেছো? তুমি জানো কেমনে তুমি সুস্থ হইছো? সামনে আহো দেহি মিয়া! পিছন থেকে সাঙ্গোপাঙ্গ শফিককে উদ্দেশ্য করে বলল, ওস্তাদ আমারার কাজ তো এখানে শেষ। চলেন যাই। শফিক আবারো হাতের ইশারায় ওদেরকে থামতে বলল। ওর চেহারায় এক ধরনের কাঠিন্য ফুটে উঠেছে। সাঙ্গোপাঙ্গ দুজনেই বুঝতে পারল শফিকের মনের ভেতর কোন একটা উদ্দেশ্য কাজ করছে। কিন্তু কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ শফিক তাঁর হাতের মোটা শক্ত বাশটি তুলে মিন্টুর মাথায় সজোরে একটা আঘাত করে বসল। 'ওমা গো!' বলে সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পরলো মিন্টু। পেছনে থাকা সাঙ্গোপাঙ্গ দুজনই দ্রুত শফিকের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। একি করলেন, ওস্তাদ! শফিক এক হুঙ্কার দিল। বলল, আশেপাশে আসবি না। মিন্টু শরীর থাইকা এই রোগ ছড়ায় পড়তো। তাই আমি ওরে খতম কইরা দিলাম। আইজ আমি যেইটা করছি এই গ্রামের ভালোর জন্যই করছি। একদিন সবাই বুঝবার পারব। পেছন থেকে একজন বলে উঠল, ওস্তাদ! মিন্টু তো সুস্থ হইয়া গেছিল। শফিক ওদের দিকে ফিরে রীতিমত একটা গর্জন করল, বলল, যা বলেছিস সেইটা এইখানেই কবর দিয়া যাবি। এই কথা যেন তোগোর মুখে এই জীবনে আর না শুনি। মিন্টু আমারার উপর হামলা করেছিল। তাই আমরা ওকে লাঠিপেটা করছি। নিজের জীবন বাচাইছি। শফিক তাঁর হাতের মোটা বাসটি সজোরে মাটিতে ঠুকে দিল। সাঙ্গোপাঙ্গ দুটি ভয়ে সিঁটকে গেল আর দ্রুত মাথা নাড়তে থাকল। শফিক খাবারের ব্যাগটা নিজের হাতে তুলে নিল। তারপর পথের দিকে পা বাড়ালো। পেছনে মিন্টুর নিথর দেহ মাটিতে পড়ে ছিল আর তার মাথা বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়া রক্ত মাটি ভিজিয়ে দিচ্ছিল।
পর্ব ৭ রহিম বক্স মিলিটারির গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল। মিলিটারি তার পিঠ চাপড়ে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করল। মিয়া ভাই, এইবার উঠো। সন্ধ্যা নাইমা আসতেছে তো। বাড়ি যাইতে হইবো। রহিম বক্স এর এবার যেন ঘোর ভাঙলো। কিছু একটা ভেবে একটু নড়েচড়ে উঠলো। তারপর চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ালো। হুম, ঠিক কইছো, মিলিটারি। বাড়ি যাইতে হইবো। ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলল সে। সন্ধ্যা নেমে আসার আগে তাদের বাড়িতে পৌঁছাতে হবে। এই কথাটি রহিম বক্স এর চেয়ে ভালো এই মুহূর্তে আর কেউ জানে না। কবরখানা দেইখা তো মনে হইতাসে তোমার কথাই ঠিক। রহিম বক্সকে উদ্দেশ্য করে বলল মিলিটারি। এই কবর শিয়াল কুকুরে খোড়া নয়। একটু থামল সে। তারপর বলল, কিন্তু ভেতর থাইকা একটা লাশ কিভাবে কবর খুঁইড়ে বাইর হইয়া আসতে পারে? মিলিটারি দ্বিধান্বিত। তবে কি মিন্টুর মা জীবিতই ছিল! তারে জীবিত অবস্থায় সবাই তারে কবর দিয়া দিছে! মিলিটারির কথার কোন জবাব দিল না রহিম বক্স। একদম চুপ মেরে আছে সে। তার কাছে অংক এখন দুয়ে দুয়ে চার। এই ব্যাপারে সে নিশ্চিত, সেদিন রাতে ওইটা মিন্টুর মা-ই ছিল আর সেটার খাদ্য ছিল তারই ছেলে। কালুর কথা ভাবতেই বিষাদ ভরা বুক নিয়ে আবারো ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল সে। এবার আর মিলিটারি তাকে থামানোর চেষ্টা করল না। বরং তার হাত ধরে দ্রুত পদক্ষেপে তাকে নিয়ে হেঁটে চলল। হঠাৎই খট করে একটি শব্দ শুনতে পেল মিলিটারি। শব্দটি তাদের থেকে পেছনে কিছুটা দূর থেকে আসছে। ভাই কিছু শুনলাম! রহিম বক্সকে উদ্দেশ্য করে বলল মিলিটারি। শব্দটির নিজেও শুনেছে রহিম বক্স। সে কান্না থামিয়ে দিয়েছে। পিছনে তাকানোর দরকার নাই মিলিটারি। চুপচাপ সামনে আগায় চলো। মুখ চাপা দিয়ে বলল রহিম বক্স। মিলিটারি কোন উত্তর করল না। আরো বড় বড় পদক্ষেপ সামনে এগিয়ে চলল। রাস্তার দু'ধার ধরে বিশাল বড় বড় পুরনো গাছ। সামনের দিকটা অন্ধকার করে রেখেছে। পথটাও কাদামাখা। ইতিমধ্যে সূর্য ডুবে গেছে। অনেকটা রাত নেমে এসেছে। অল্প কিছুটা আলো এখনো রয়ে গিয়েছিল। সেই আলোয় রহিম বক্স পেছনে তাকিয়ে দেখল একবার, তাদের থেকে বেশ কিছুটা দূরে পেছনে রাস্তায় কেউ একজন ধানক্ষেত থেকে ধীরে ধীরে উপরে উঠে আসছে। তার চলাফেরা, শরীরের দুলুনি রহিম বক্স এর কাছে ভালো ঠেকলো না। তার কাছে যেন এরকম শরীর টেনেহিঁচড়ে চালিয়ে নিয়ে যাওয়াটা কারো বা কিছু একটার অনুকরণ মনে হল। কথাটি ভাবতেই ভাবতেই সে কিছু একটা আচ করতে পারল। এই অনুকরণ আর কিছুই নয়, মিন্টুর মায়ের লাশের শারীরিক ভাষা! হঠাৎ করে রহিম বক্স এর সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো। চাপা কন্ঠে মিলিটারির উদ্দেশ্যে বলল, মিলিটারি, দৌড় শুরু করো। মিলিটারি প্রথমে তার কথা ধরতে পারল না। এবার রহিম বক্স একটু জোরে বলল, দৌড়াও মিলিটারি। বলেই সে নিজে দৌড় দিতে আরম্ভ করলো। কাদামাখা পিচ্ছিল পথে দৌড়ানো যে কতখানি কষ্টের সেটা তারা দুজনে ভালোই টের পেল। দৌড়াতে দৌড়াতে একবার পেছন দিকে তাকালো রহিম বক্স। কালো অশুভ ছায়াটি যেন তাদের পেছনে দৌড় দিতে শুরু করেছে। প্রথমে ব্যাপারটি বুঝে উঠতে পারেনি কেউ। একটু পরে যেটা বুঝতে পারল তাতে করে হৃদপিন্ডের গতি যেন হাজার গুণ বেড়ে গেল। কালো ছায়াটি কি তবে সত্যি সত্যি তাদের পেছনে দৌড়াতে শুরু করেছে! কতক্ষণ এইভাবে দৌড়াচ্ছে জানা নেই দুজনের। মনে হচ্ছিল হাজার ঘন্টা পার হয়ে গেছে কিন্তু এই পথ শেষ হচ্ছে না। দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ করেই  কাদায় পা সটকে পড়ে গেল মিলিটারি। তৎক্ষণাৎ থেমে গেল রহিম বক্স। দ্রুত তার কাছে গিয়ে হাত দুটি ধরে টেনে উঠানোর প্রানপন চেষ্টা করলো। এরমধ্যে অশুভ ছায়াটি আরো অনেক দূর সামনে এগিয়ে এসেছে। সেটার বিকট আর্তচিৎকারে কয়েক মুহুর্তের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল রহিম বক্স। মিলিটারি তার অবস্থা দেখে বলল, মিয়া ভাই, তুমি দৌড়াও! দৌড়াও, মিয়া ভাই! নিজের জীবন বাঁচাও! মিলিটারিকে ছেড়ে যেতে চাইলো না রহিম বক্স। কিন্তু তাকে এখন আর সে সাহায্যও করতে পারবে না সে। ছায়াটি অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছে। উপায়ন্তর না দেখে মিলিটারিকে ফেলে রেখেই দৌড় শুরু করলো রহিম বক্স। আশেপাশে আর তাকানোর সুযোগ নেই। সে জানে তাকে এখান থেকে বের হতে হবে। এই জিনিসের হাতে ধরা পরলে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবে না সে। ছুটতে ছুটতে কত দূর চলে এসেছে জানা নেই তার। এর মধ্যে একবারও পেছনে ফিরে তাকায়নি সে। সামনে হাতের ডানে একটি বাক দেখতে পেল রহিম বক্স। বাক ঘুরতে ঘুরতে একবার পেছনে তাকাল। আকাশে সূর্য নেই। চারিদিকে অন্ধকার নেমে গেছে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না পেছনে। চিৎকারের শব্দ পেছনেই ফেলে এসেছে সে। ... রহমান চাচার দোকানে বসে সবুর দেওয়ান আড্ডা দিচ্ছিল আর হাতে নিয়ে দামী বিড়ি খাচ্ছিল। রহমান আমার মনে হয় তোমারও দোকানপাট বন্ধ করে দেয়া উচিত। দেশের যা অবস্থা এইভাবে দোকানপাট খোলা রাখলে মানুষের আড্ডা বাড়বে। চলাচল বাড়বে। হ, আমিও তাই ভাবতেছিলাম। রহমান উত্তর দিল। আমারও তো জানের ভয় আছে। কত রকমের কত গ্রামের লোকজন সারাদিন দোকানে আসা যাওয়া করে। কে ঢাকা শহর থাইকে আসছে তা তো বোঝার উপায় নাই। কিন্তু পেটের দায়ে দোকান চালাইতে হয়। নিরুপায় কন্ঠে বলল রহমান চাচা। শুনলাম রহিম বক্সের এক পোলা নাকি হারায় গেছে? সবুর দেওয়ান জানতে চাইল। হ, আমিও তাই শুনছি। রহমান উত্তর দিল। এই গ্রামে কি শুরু হইল একজনের পর একজন মানুষ নিখোঁজ হইতাছে! আরে দেখো কোথায় চুরি-চামারি করতে গিয়ে ধরা খাইছে। আটকায় রাখছে না হয় জেলহাজতে দিছে। কাল বাদে পরশু গেরামে খবর হইয়া যাইবে। সবুর দেওয়ান উত্তর দিল। তা হইবার পারে। রহিম বক্স এর এই পোলাটা খুবই চঞ্চল আর মেলা দুষ্ট। গ্রামে গ্রামে ওর নামে বদনাম আছে। প্রতিমাসেই দুই-চারটা বিচার আচার আসে। কারো আম গাছে তো কারো জাম গাছে তার চলাচল। বরই, পেয়ারা কিছুই বাদ রাখে না। নির্বিকারে বলল রহমান। হুম ঠিকই কইছো। বলল সবুর। শেষ মাসে টুটপাড়ার মাখনলালের পোলা দিলিপ হারায় গেল না? হের কি আর খোজ পাইছিল কেউ? প্রসংগ পাল্টালো রহমান। কিন্তু সবুর দেওয়ান কোন উত্তর দিল না। একটু পর বলল, আচ্ছা আইজ আমি উঠলাম রহমান। বাকির খাতায় কত টাকা খাইছি লিখা রাইখো। কথাটি বলেই সবুর দেওয়ান বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ালো। মুখে ধরা দামি বিড়িতে আরেকবার সুখ টান দিলো। তারপর মাটিতে ফেলে পা দিয়ে মেরে দিল। পকেট থেকে চাবি বের করে সেটি ঘুরাতে ঘুরাতে বাইকের সামনে গেল। বাইক স্টার্ট দিয়ে মুহূর্তেই সেখান থেকে গায়েব হয়ে গেল। কাল��ম, সন্ধ্যা হইয়া পড়ছে। মিলিটারি তো এখনো বাড়ি ফিরল না। বুড়ো সৎ বাপের চেহারায় চিন্তার ছাপ। মিয়া ভাই, মাঝেমধ্যেই একটু দেরি কইরা বাড়ি ফেরে। এইডা আর নতুন কি। একটু মুখটা বাঁকা করে উত্তর দিল কালামের বউ। দেখি আরেকটু অপেক্ষা কইরে। এর মধ্যে না ফিরলে আমি খুজতে বাইর হইবো। খাটিয়ায় বসা কালাম বলল। কালামের বউ সাথে সাথেই ঘুরে উঠে কালামের পাশে গিয়ে বসল। বলল, খবরদার আপনে এই রাইতে কোথাও যাইবেন না। কালাম কোন উত্তর দিল না। তার বউ আবার বলে উঠল, আপনে কোনভাবেই যাইতে পারবেন না। আমি যাইতে দিমু না। কালাম তবুও চুপ। 
পর্ব ৮ রহিম বক্স দৌড়ে কিছুটা নিরাপদ দূরে চলে যেতে পারলেও, মিলিটারি তখনও রাস্তায় কাদার উপর পড়ে। সারা শরীর কাদাপানিতে মাখামাখি। কোন রকমে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের দিকে তাকাল মিলিটারি। পেছনে ভয়াবহ অবয়বটি এখন তাকে প্রায় ছুঁই ছুঁই। আছড়ে পড়ে তার ডান হাতের কনুইতে বেশ লেগেছে। তৎক্ষণাৎ কিছু বোঝা না গেলেও মিলিটারির মনে হল সেটি মচকে যেয়ে থাকতে পারে। পেছনে ছায়াটি বিকট শব্দ করতে করতে অনেকটা কাছে চলে এসেছে এখন। কয়েক মুহূর্তেই মনে হয় ধরে ফেলবে তাকে। মিলিটারিও সহজে হার মানার পাত্র নয়। সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার পর সেখানকার মানসিক, শারীরিক চাপ সে নিতে পারেনি সত্যি। সেনা অফিসারদের ব্যঙ্গ বিদ্রুপ তার আত্মসম্মানে প্রচুর আঘাত হানে। চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে অনেকটা পালিয়েই চলে আসে। আজো সেই কথা মনে হলে নিজেকে বড় কাপুরুষ মনে হয়। কিন্তু মিলিটারি কাপুরুষ নয়। তার ভেতরের একটা অংশ সবসময়ই সেটি মনে করে এসেছে। এবং সেটা আজ প্রমাণ হতে চলেছে। মিলিটারি আজ হার মানল না। নিজেকে টেনে হিঁচড়ে কোন রকমে রাস্তার কিনারায় নিয়ে গেল। কিনারা থেকে এক রকম গড়িয়েই পাশের ক্ষেতের উপর গিয়ে পড়ল। ভাগ্য তার সহায় ছিল। ছোটখাটো কিছু আচড়, চিড়ে যাওয়া ছাড়া বড় কোনো আঘাত লাগেনি। নিজেকে কোনরকমে টেনে তুলে ক্ষেতের আইল ধরলো সে। ছোট ছোট পায়ে দুলতে দুলতে সামনের দিকে এগিয়ে চলল। একবার উপরে রাস্তায় তাকিয়ে ছায়াটির অবস্থান বোঝার চেষ্টা করলো। মিলিটারিকে লক্ষ্য করেছে সেটি। এই দিকে ছুটে আসছে। মিলিটারির শরীরে ততক্ষনে আরষ্টতা ভর করছে। পা দুটি যেন ভারী হয়ে আসছিল তার। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও ছুটে চলা বন্ধ করেনি সে। মিলিটারি জানে ছায়াটি খুবই ক্ষিপ্রগতির। সেটির সাথে দৌড়ে পেরে এক রকম অসম্ভব। কিন্তু তবুও হাল ছেড়ল না সে। কিছুদুর যেতেই পেছনে ঝপাৎ করে একটি শব্দ শুনতে পায় মিলিটারি। ছায়াটি রাস্তার উপর থেকে নিচে লাফিয়ে পরেছে। আবছা চাঁদের আলোয় সেটার শারীরিক ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে ক্ষেতের কাদামাটির ভেতর হাঁটু অবধি গেড়ে গেছে। এলোপাতাড়িভাবে অনবরত হাত দুটি ছুটে চলছে। অদ্ভুতভাবে শরীর বাকাচ্ছে, কোন মানুষের পক্ষে সেটি করা সম্ভব নয়। অপার্থীব এই প্রাণীটি বেশিক্ষণ এখানে আটকেও থাকবে না জানে মিলিটারি। তবে এতটুকু সময়ও এখন তার জন্য আশীর্বাদ। তাকে এর মধ্যে যথাসম্ভব নিরাপদ দূরত্বে চলে যেতে হবে। মিলিটারির মনের বল যেন আরো বেড়ে গেল। আগের চেয়ে পা দুটি এখন বেশি সচল মনে হচ্ছে। চিত্কারটিও এখন খানিকটা পেছনে পড়ে গেছে। কিন্তু মিলিটারি জানে এই ছায়াটি নাছোড়বান্দা। খানিকটা দূরে চলে আসার পর তার এই ধারনাটি যে সঠিক সেটি বুঝতে পারল সে। ক্ষেতের মধ্য দিয়ে ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দে জন্তুটি ঠিকই তার দিকে এগিয়ে আসছে। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি আইল ধরে ফেলবে। . অনেক রাত হয়েছে। রহমান চাচা তার দোকান বন্ধ করবে। প্রায় সবগুলি কপাট নামিয়ে ফেলেছে। হঠাৎ লক্ষ করল ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে কেউ একজন দৌড়ে এই দিকেই এগিয়ে আসছে। একটু অবাক হল সে। এই রাতে ধান ক্ষেতের মধ্যে কে? কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে তার হাতের টর্চটা উঁচু করে আলো ফেলল। ফকফকে সাদা আলোতে মিলিটারির চেহারাখানা দেখতে পেল সে। মিলিটারি পড়িমড়ি করে দৌড়ে রাস্তার উপরে উঠে আসার চেষ্টা করছে। রহমান মিলিটারিকে টেনে উপরে উঠতে সাহায্য করলো। তার বিধ্বস্ত চেহারা দেখে সে যারপনাই অবাক হল রহমান। মিলিটারি হইছে কী তোমার? হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল সে। মিলিটারি কোন জবাব দিতে পারল না। হাঁপাতে হাঁপাতে রহমান চাচার হাত ধরে টেনে দোকানের ভেতরে নিয়ে গেল। তারপর ঝুকে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল, কপাটটা বন্ধ করো, চাচা! হইছে কি? চোর ডাকাত পরছে নাকি? রহমান চাচার চোখে মুখে তখনো বিস্ময়। সে হাতে ধরা টর্চটি ধান ক্ষেতের দিকে তাক করল। মিলিটারি সাথে সাথে তার হাতটি ধরে নিচে নামিয়ে দিল। বলল, শিগগির আলোটা বন্ধ করো।   রহমান চাচা টর্চ নিভিয়ে দিল। ভয়ার্ত চোখে জিজ্ঞেস করল, আমরারে খুইলা বল, কোন জন্তু জানোয়ার না তো? মিলিটারি অস্ফুট স্বরে শুধু বলল, তার থেকেও বহুগুনে খারাপ কিছু। তুমি দোকানের কপাটটা নামাও। কথাটি বলে সে নিজে থেকে কপাটগুলি টেনে নামাতে শুরু করে দিল। মিলিটারির ক্ষিপ্রতা দেখে কিছু একটা আন্দাজ করতে পারল রহমান চাচা। নিজে বাকি কপাটগুলি চটপট করে টেনে নামিয়ে দিল। কিছুক্ষণের জন্য বাইরে সবকিছু শান্ত ছিল। রহমান চাচা মিলিটারির পাশে চুপ করে বসে আছে। কিছু একটা বলতে যাবে সে, এমন সময় দোকানের বাইরে কিছু একটার হ্যাচরানোর শব্দ শুনতে পেল সে। তার কাছে মনে হল, কেউ যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাইরে মাটির রাস্তায় হেঁটে চলছে। মিলিটারি কোন টু শব্দটি করল না। জড়োসড়ো হয়ে ঘরের এক কোনায় বসে রইল। হাত দিয়ে টেনে রহমান চাচাকে নিজের কাছে নিয়ে আসার চেষ্টা করল। রহমান চাচা ভাবলো, কোন হিংস্র জন্তু জানোয়ার হবে হয়তো। ঠিক তখনি জিনিসটি এক ধরনের অর্ধ জান্তব অর্ধ মানবিক চিৎকার করে উঠলো। সেটাকে ঠিক চিৎকারও বলা যাবে না। এক ধরনের গোঙ্গানি। যেন কোন অসুস্থ বুড়ো মানুষ নিঃশ্বাসের সাথে লড়াই করছে। লড়াইয়ের এক পর্যায়ে মুখ থেকে অপার্থীব  শব্দ বেরিয়ে পরছে। রহমান চাচা মিলিটারিকে ফিসফিসিয়ে বলল, কোন অসুখে মানুষ! মিলিটারি রহমান চাচার হাতটি তখনো শক্ত করে চেপে ছিল। মুখে তর্জনী এটে চাচাকে একদম চুপ থাকার ইঙ্গিত করল। রহমান চাচার উৎকণ্ঠা তখনও কমেনি। এবার টিনের ফুটো দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করল সে। অন্ধকারে তাৎক্ষণিক কিছু চোখে পড়ল না। হঠাৎ লক্ষ করল একটু দূরে কিছু একটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে নড়েচড়ে চলছে। হেলে দুলে এরকম নির্জীব চলার ভঙ্গি তার কাছে ঠিক স্বাভাবিক লাগলো না। এবার খানিকটা ভয় পেয়ে গেল রহমান চাচা। তার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো। মনে হল, কোন মানুষের অঙ্গভঙ্গির এরকম নয়। মিলিটারির দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে ফিসফিসে গলায় বলল, এইটাতো অন্য কিছু! মিলিটারি মুখে 'শশ' শব্দ করে আবারো তাকে চুপ করিয়ে দিল। রহমান চাচা এবার জোরে জোরে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। ভুত-প্রেত হবে, এরকম কিছু একটা আন্দাজ করে চোখ বন্ধ করে দোয়া দুরুদ পড়তে শুরু করল। এরপর কেটে গেছে অনেকটা সময়। শব্দটি ধীরে ধীরে দূরে মিলিয়ে গেছে। সম্ভবত সেটি এই এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। এদিকে রহমান চাচা যেন মিলিটারির চেয়েও বেশি ভয় পেয়ে গেছে। ভয়ে শক্ত হয়ে জমে গেছে। মিলিটারি খুব সন্তর্পনে উঠে কপাটের ফাঁক দিয়ে রাস্তার এপাশ-ওপাশ তাকালো। কোন কিছু এখন তার নজরে এলো না। রহমান চাচাকে উদ্দেশ্য করে সে বলল, চলো বাড়ি যাই, চাচা। অসম্ভব! আমি সকালের আগে এইখান থেইকা বাইর হইতাসি না, মিলিটারি। রহমান চাচা প্রায় সাথে সাথেই জবাব দিল। কিছুক্ষণ দুজনের কেউ কোন কথা বলল না। একটু পরে মিলিটারি বললো, তুমি থাকতে চাইলে থাকো। আমি যাইতেসি। আমারে একলা রাইখা যাইও না, মিলিটারি। রহমান চাচার আকুতি। আমি না গেলে বাড়ির লোক আমার জন্য চিন্তা করব, চাচা। মিলিটারি উত্তর দিল। সে চায় না কেউ তাকে খুঁজ��ে বের হোক। খুব সন্তর্পনে দোকানের এক পাশের একটি কপাট খুলে ফেলল মিলিটারি। তারপর সেটির ফাক গলিয়ে নিজের দেহটি বের করে নিলো। পেছনে রহমান চাচা আর কিছু বলল না। রাস্তার এমাথা-ওমাথা একবার তাকাল মিলিটারি।  তারপর ছোট ছোট পদক্ষেপে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল। . এদিকে কালাম তার ভাইকে খোঁজার উদ্দেশ্যে হাতে একটি টর্চ নিয়ে রওনা করে দিয়েছে। বউয়ের হাজার বারণ সত্ত্বেও নিজেকে আজ দ��িয়ে রাখতে পারেনি সে। ভাবলো অনেক হয়েছে এখন থেকে আর বউয়ের ধমক, বদমেজাজের তোয়াক্কা করবে না। এই বউয়ের কথা শুনে সে তার মাকে অনেক অবহেলা করেছে। যখন তার মার তাকে খুব প্রয়োজন ছিল সে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বউয়ের সাথে সময় কাটিয়েছে। অপরদিকে তার ভাই সর্বদা মায়ের খেদমত করে গেছে। নিজের স্ত্রী মারা যাবার পরেও দ্বিতীয় বিয়েটি করেনি। সর্বাত্মকভাবে পুরোটা সময় সে তার মায়ের সেবা-যত্ন করে গেছে। সেই মায়ের জন্য সে এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছে। হারিয়ে যাওয়ার রহস্য খুঁজে বেড়াচ্ছে। এ গ্রাম ও গ্রাম তার খোঁজ করে বেড়াচ্ছে। কালাম এখন এই ভেবে কষ্ট পাচ্ছে তার কি সুন্দর একটি পরিবার ছিল কিন্তু সে কখনো সেটির মূল্য বুঝতে পারেনি। সবসময় বউয়ের আঁচলের নিচে লুকিয়ে ছিল। তার মাকে এখনো কেউ খুঁজে পায়নি। এরকম হঠাৎ করেই একদিন রাতে হারিয়ে গিয়েছিল সে। সেদিন রাতে তার ভাই হন্যে হয়ে সারা গ্রাম খুঁজে বেরিয়েছে। কালাম বাড়িতে বসে ছিল। হয়তো সেদিন সে খুঁজতে বের হলে আজ তার মা বাড়িতে থাকতো। ভাইয়ের ক্ষেত্রেও সেই একই ভুলটি করতে নারাজ সে। হাতে টর্চ জ্বেলে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে কালাম। কিছুটা পথ হেটে যাবার পর, রাস্তার ডানে একটা ডোবায় একটা কিছুর শব্দ শুনতে পেল সে। উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে সেই দিকে এগিয়ে গেল সে। . পরদিন সকাল রহমান চাচার ছিন্নভিন্ন দেহটা দোকানের ভেতর উপুর হয়ে পড়ে ছিল। সকালে পূব পাড়ার হাজী শেখ সদাই নিতে আসলে এই ঘটনা দেখতে পায়। ঘটনাস্থলে ততক্ষণে থানা সদর থেকে পুলিশ চলে এসেছে। ইতিমধ্যে প্রচুর মানুষের ভিড় জমে গেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ কেঁদে ফেলেছে। রহমান চাচার সাথে গ্রামের অনেকেরই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মেলা বছরের দোকান তার এই তল্লাটে। অনেক জোয়ান ছেলেপেলে বাড়ির থেকে তার দোকানে বেশি সময় কাটাতো। তাদের কেউ কেউ কেঁদে ফেলেছে। হঠাৎ একজন খেয়াল করল একটি ছিন্ন হাত দোকান থেকে কিছুটু দূরে ডোবার ধারে পড়ে আছে। পুলিশের একজন হাতটি তুলে এনে পলিথিনে পেচিয়ে গাড়িতে রাখল। দারোগা সাহেব এলাকাবাসীকে এটা সেটা প্রশ্ন করছিলেন। কিন্তু কেউই কোন সদুত্তর দিতে পারছিল না। কারো ধারণা নেই কে বা কিসে এই লোকটাকে এভাবে ছিন্নভিন্ন করে রেখে গেছে। কেউ কেউ বলছে কোন জন্তু জানোয়ার এই কাজ করেছে। কেউ বলছে গ্রামের ভেতর বাঘ ঢুকে পড়েছে। যদিও পুলিশ এই তথ্যটিকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। অনেকের কাছে আবার পুলিশের এরুপ আচরণ সন্দেহজনক লাগে। পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবেই এটিকে খুনের চেয়ে জন্তুর দ্বারা আক্রান্ত ঘটনা হিসেবে বেশি প্রাধান্য দিয়ে যাচ্ছে। যদিও তারা মুখে বলছে কোন শিয়াল-কুকুরজাতীয় প্রাণী কাজটি করে থাকতে পারে কিন্তু কিছু কিছু পুলিশ সদস্যের চেহারায় তার থেকেও ভয়ানক কিছু একটার ভাবনায় স্পষ্ট আতঙ্ক ফুটে উঠেছে। গ্রামবাসীর অনেকেই সেটি লক্ষ্য করেছে। হঠাৎ করে একটি ছোট ছেলে তার মায়ের আঁচল  টানতে টানতে বলে ওঠে, মা, মা মাথাটাতো আধা খাওয়া। কিসে খাইসে? পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ওর মা কথাটি শুনে সাথে সাথে ছেলেটিকে কোলে তুলে নিয়ে সেখান থেকে কেটে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশও লাশটি প্যাকেটে মুড়ে গাড়িতে তোলে। তারপর ধুলো উড়িয়ে সামনে এগিয়ে  চলে গাড়ী। পেছনে সবাই তাকিয়ে থাকে গাড়িটির দিকে। আজ চলে যাচ্ছে এই গ্রামের বিবিসি। আর কোনদিন শোনা হবে না, আর কেউ দিতে পারবে না গ্রামের মানুষের প্রতিদিনকার খবরা-খবর। এই ঘটনার পর গ্রামের মানুষ বেশ ভয় পেয়ে গেছে। অনেকেই পুলিশের কাছে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ করেছে। পুলিশ সবাইকে ঘরে থাকার অনুরোধও করে গেছে। . সকালে সামসু আর হাসেম মিন্টুর বাড়িতে তাকে দেখতে গেল। বাড়ি পৌঁছতেই সামসু দেখল মিন্টু ভাইয়ের রক্তমাখা লাশ উঠোনে পড়ে আছে। মাথা থেকে অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। উঠোনের অনেকটাই ভিজে গেছে। এখন সেই রক্ত জমাট বেঁধে শক্ত কালো হয়ে গেছে। দৃশ্যটি দেখে শামসু আঁতকে ওঠে। নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে মিন্টুর লাশের কাছে দৌড়ে যায়। সামনে গিয়ে বুঝতে পারে মিন্টু ভাই অনেক আগেই মারা গেছে। ইতিমধ্যে লাশ থেকে দুর্গন্ধ বের হওয়া শুরু হয়ে গেছে। সামসু মাথা ঘুরিয়ে হাসেমের দিকে তাকায়। হাসেমের চোখদুটি ততক্ষণে ছল ছল করে উঠেছে। পর্ব ৯ ভোরের দিকে বাইরে কালামের ডাকাডাকি শুনে ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসে মিলিটারি। বাড়ির কেউ সারারাত ঘুমায়নি। শেষ রাতের দিকে বাড়ি ফিরেছে মিলিটারি। সারারাত নামাজের পাটিতে বসে ইবাদত করেছে তার সৎ বাপ। মিলিটারির পেছনে পেছনে কালামের বউ ছুটে আসে উঠোনে। সবার পেছনে ধীর পায়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় তাদের বুড়ো বাপ। সে ঘর থেকে বের হতেই দেখতে পায় উঠোনে সবাই স্থির দাঁড়িয়ে আছে। কারো মুখে টু শব্দটি নেই। মিলিটারি কিছু একটা দেখে থমকে দাড়িয়ে পরেছে। উঠানের উপর কালামের স্ত্রীর হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে যেন তাকে সামনে এগিয়ে যেতে বাধা দেয়ার চেষ্টা করছে। ধীর ধীরে বুড়ো উঠানের দিকে এগিয়ে চলল। দেখল  কুজোবুড়িকে কোলে করে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে কালাম। কি হইল ভাইজান? কালামের মুখখানা একটু ম্লান হয়ে যায়। অবাক হয়ে বলে, আরে আমারার মায়েরে পাইছি! মিলিটারি তখনও কোন উত্তর দেয় না। তার ঘোর কাটেনি। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সর্বপ্রথম যে কথাটি তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, তা হল, মায়ের মুখ কাপড়ে বাঁধা কেন? কে বাধছে? কালাম একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। উত্তর দেয়, আমি বাঁধছি। আমরার কাছ থেকে হারায় গিয়া মায় পাগলের মত আচরণ করতেছিল। তাই আমি জোর করে তার মুখ কাপড় দিয়া বেঁধে দিছি। মায় কি তোমারে কামরাইবার চাইছিল? মিলিটারি জিজ্ঞেস করে। হয়, ওই রকমেরই কিছু একটা। তয় তুমি বুঝলা কেমনে। এখনই তোর কোল থাইকা মায়েরে নামা! মিলিটারি প্রায় চিৎকার করে বলল। কি হইছে? মিলিটারির দিকে তাকিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে বুড়ো বাপ জিজ্ঞেস করল। মিলিটারি কোন উত্তর দিল না। কালামের উদ্দেশ্যে আবার বলল, কালাম শিগগির নামা মায়েরে। কালাম তখনও কিছু বুঝে উঠতে পারে নাই। ভাইজান ম্যায় তো হাটবার পারে না। আমি তারে সেরাজুলদের ডোবা থাইকা উঠায় নিয়ে আসছি। পানিতে পইড়া ছটফট করতেছিল। আমি তারে ওই সময় দেখতে পাইছি। খোদায় তারে জানে বাঁচায় দিছে! কালামের বউ দৌড়ে তার কাছে যেতে চায়। মিলিটারি তখনো শক্ত করে তার হাত ধরে ছিল। খবরদার তুমি সামনে যাইবা না। মিলিটারি বলে। আপনি দেখেন না সে মায়েরে খুঁইজা পাইসে? হইলো কি আপনার? আপনি কি পাগল হইয়া গেছেন? আমার হাত ছাড়েন? কালামের বউ অনেকটা জোর করেই মিলিটারির কাছ থেকে হাত ছাড়িয়ে নিল। এখন কোথায় গেছে আপনার সব মায়া? বলতে বলতে সে কালামের কাছে এগিয়ে যায়। দুজনে মিলে কুজোবুড়িকে ধরে ঘরের দিকে নিয়ে যায়। মিলিটারি কিছু একটা বলতে গেলে, তার বুড়ো সৎ বাপ তাকে চোখ রাঙানির দিয়ে এক রকম শাসিয়ে দেয়। উঠোনের মাঝে কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে একা দাঁড়িয়ে থাকে মিলিটারি। . সামসু আর হাশেম এক দৌড়ে মিন্টুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। কয়েকটি ধানী জমি পরেই রফিক চাচার বাড়ি। তারা দৌড়ে তার বাড়িতে যায়। দরজায় খটখট শব্দ করতেই রফিক চাচার স্ত্রী দরজা খুলে। সামসু আর হাসেমকে দেখে সে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। তৎক্ষণাৎ তাদের ���ুখের উপর ঠাশ করে দরজা বন্ধ করে দেয়। তার কিছুক্ষণ পর রফিক চাচা ভেতর থেকে ধমকের সুরে বলে, সামসু হাসু তোরা আমার বাড়ির সামনে কি করস? তোদের তো এক মাস ঘরে থাকবার নির্দেশ দিসে মেম্বার সাব? সামসু কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে, চাচা মিন্টু ভাই মারা গেছে। মিন্টু ভাইয়ের লাশ তার উঠোনে পইড়ে আছে আইজ দুই দিন। কথাটা শুনে সাথে সাথে ঘরের ভেতর থেকে রফিক চাচার বউ চিৎকার করে ওঠে, বলে, ওরা মিন্টুর বাড়ি গেছে। গোলামের পো গোলামগুলারে শিগগির খেদাও! রফিক চাচা উত্তেজিত হয়ে ভেতর থেকে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলে, সামসু আমার উঠান থেইকা এক্ষুনি বাইর হ! তোরা আর কখনো আমার বাড়ির আশেপাশে আসবি না! এ পাড়া ওপাড়া ঘুইরে বেড়াস! আমি আজি মেম্বরের কাছে বিচার দিমু। সামসু ও হাশেম আর কোন কথা বলে না। নিরবে রফিক চাচার বাড়ি ত্যাগ করে। যাওয়ার পথে সামসু হাসেমকে উদ্দেশ্য করে বলে, আমরা কি এমন অন্যায় করছি। আমরা তো সর্বদা মানুষটারে সাহায্য করার চেষ্টা করছি। দিনকাল কেমন পাল্টে গেছে। আজ মানুষের উপকার করলেও তিরস্কার শুনতে হয়। হাসু শুধু মাথা নাড়ে। সে এখনো দুঃখ হতাশায় নিমজ্জিত। আমার কেন জানি মনে হয় মিন্টু ভাইরে কেউ মাইরা ফেলাইছে। শামসু বলে। এবার যেন আঁতকে উঠে হাসেম। শামসুর দিকে তাকিয়ে বলে, কি কও ভাই? তোমার এমন কেন মনে হইল? হরে, আমি তার মাথায় আঘাতের চিহ্ন দেখছি। কেউ তারে লাঠি দিয়া বাড়ি মারছে। একটা দীর্ঘশ্বাস নেয় সে। তার চেহারায় এক ধরনের কাঠিন্য ফুটে ওঠে, বলে, শফিক গুন্ডা এই কাজ কইরা থাকবার পারে। ওই হারামজাদা আগেও এই রকম কাজ কইরা পার পাইয়া গেছে। ভাই তয় ওরাতো আমরারেও মাইরা ফালাইবো! হাসেমের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। আমার তো ভয় লাগতেছে রফিক চাচা যদি কিছু বইলা দেয়। ওরা বাড়ি যাবার ঘণ্টাখানেক পরেই শফিক তার সাঙ্গ পাঙ্গ নিয়ে সামসুর বাড়ির সামনে এসে হাজির। তারেক এক সাঙ্গো সামসুকে নাম ধরে ডাক দেয়। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসতে বলে। হাসেমের বাড়ি সামসুর ঠিক পাশেই। হাসেম সব কিছু শুনে চুপচাপ ঘরের ভেতর লুকিয়ে থাকে। সামসু একটি গেঞ্জি গায়ে দিতে দিতে বাইরে বেরিয়ে আসে, বলেন কি হইছে, শফিক ভাই? ঘরের ভিতরে থাকবার জন্য বলা হয়েছে না তোমাগোর? একমাস ঘরের ভিতরে থাকবা। বাইরে ঘুরাঘুরি কইরা বেড়াও কেন? একটু কপট হাসি হেসে কথাগুলি বলল শফিক। ভাই আমরা তো কেউ ঘর থেকে বাইর হই নাই। শামসুর সরাসরি জবাব দেয়। শফিক এবার নিজের দাঁত কিড়মিড় করে, বলে সত্যিই বাইর হও নাই? শামসু বলে, না আমরা সেদিনকার পর থাইকা বাড়ি থাইকা বাইর হই নাই। শফিক কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল কিন্তু বলতে পারল না। শুধু বলল, ঠিক আছে মিয়া। কথাটা মনে রাইখো। আমি কিন্তু তোমারার উপর নজর রাখতেছি। আইজ গেলাম। পর্ব ১০ অস্থিরভাবে বিছানার উপর ছটফট করছে রহিম বক্স। গায়ে প্রচন্ড জ্বর। সারা শরীরে কাপুনি দিয়ে কিছুক্ষণ পরপর থর থর করে কেঁপে উঠছে সে। একবার, দুইবার। এইবার বোধহয় আর রক্ষা হলো না তার। অসুস্থ হয়েই মারা যেতে হবে তাকে। কিছুই ভাবতে পারছিল না রহিম বক্স। তার পুরো পৃথিবীটা যেন উলটপালট হয়ে গেছে। চারপাশটা ভনভন করে ঘুরছে। রহিম বক্স এর স্ত্রী তার মাথায় জলপট্টি লাগিয়ে দিচ্ছিল। রহিম বক্স তার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে নিচু স্বরে বলল, আমার বাজানগের খেয়াল রাইখো গো ছোট্টুর মা। স্ত্রী তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে, বলে, চুপ করেন। আপনের কিছু হইব না। আপনি ভালো হইয়া যাইবেন। রহিম বক্স কোন উত্তর করে না। তার স্ত্রীকে ছোট্টকে ডাকতে বলে। পাশের ঘরেই ছোট্ট তার ভাইদের সাথে করছিল। মায়ের ডাক শুনে মেজোটাকে খেয়াল রাখতে  বলে দৌড়ে এই ঘরে চলে আসে সে। রহিম বক্স তার দিকে তাকিয়ে বলে, কাছে আয় বাপ! ছোট্টু রহিম বক্সের হাত চেপে ধরে বিছানার পাশে গিয়ে বসে। যদি আমার কিছু হই যায়, তুই সবার খেয়াল রাখিস। ভাঙা ভাঙা গলায় কথাটি বলে রহিম বক্স। বাজান, কিছু হইব না আপনের! বলেই চোখ দুটি  ছলছল করে ওঠে ছোট্টুর। রহিম বক্স এর স্ত্রী আর কান্না ধরে রাখতে পারে না। ছোট্টকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ওঠে। . বেলা যত বেড়ে চলছে, মিলিটারির মায়ের অস্থিরতাও যেন ততো বেড়ে চলছে। পুরো সকাল মিলিটারি ঘরের ভেতরে পা রাখেনি। কালামের বউ তাকে অনেক কটুক্তি শুনিয়েছে। যদিও মিলিটারি তার কিছু গায়ে মাখেনি। এই বাড়িতে বরাবরই কালামের প্রভাব বেশি। মিলিটারিকে সবাই একজন ব্যর্থ মানুষ হিসেবেই দেখে এসেছে। জীবনের প্রতিটি জায়গাতেই সে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ তারই ছিল সবচেয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। আজ সে হতে পারত এই গ্রামের গর্ব। কিন্তু জীবনের প্রতিটি সুযোগই নষ্ট করেছে সে। এখন বাপের পুরনো কিছু জমির দেখাশোনা করে সেগুলির ফসল তুলে সংসারে খরচ দেয়। অন্যদিকে কালামের গঞ্জে বড় দোকান আছে। মোটামুটি কালামের টাকাতেই তাদের সংসার চলে। তাই মিলিটারি সবসময়ই অবহেলিত। আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগতে থাকা একজন দুর্বল মানুষ। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ করেই কালামের বউ তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। মিলিটারির উদ্দেশ্য বলে, ভাইজান, একটু ঘরে আসেন। উত্তরে কি হয়েছে জানতে চায় মিলিটারি। মায়ের ছটফটানি কেমন যেন অস্বাভাবিক রকম বাইড়া গেছে। জবাব দেয় কালামের বউ। আমরা কেউ তারে ধইরা রাখবার পারতেছি না। কথাটা শুনে মিলিটারি এক মুহুর্তও দেরি না। দৌড়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে। দেখে কালাম ও তার বাবা দুজনে বহুকষ্টে কুজোবুড়ীর দুই হাত চেপে ধরে রেখেছে। এর মধ্যেও কুঁজো বুড়ি ভয়ঙ্করভাবে মোচড় দিয়ে দিয়ে উঠছে। তাকে দুই পাশ থেকে ধরে রাখাটা বেশ কষ্টকর হয়ে উঠেছে। মিলিটারির বাপ-ভাই তাকে ধরে রাখতে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে। মিলিটারি কালামের বউকে দ্রুত এক গোছা দড়ি নিয়ে আসতে বলে। ঘরের এই কোনা ওই কোনা খুঁজে কালামের বউ কোথা থেকে এক গোছা পাটের দড়ি নিয়ে আসে। মিলিটারি তার মায়ের এক হাত খাটের থামের সাথে বাঁধতে শুরু করে। কালাম অন্য হাতটি তখনও শক্ত করে ধরে রেখেছে। মিলিটারি চিৎকার করে, বলে, মায়ের মুখের কাপড় খুইলা দিছে কে? কেউ কোন জবাব দেয় না। কালাম কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক তখনই  কুজোবুড়ি কালামের হাতে তীর বেগে একটি কামড় বসিয়ে দেয়। এক কামড়ে তার হাত থেকে এক টুকরো মাংস ছিড়ে নেয়। কালাম কোনরকমে হাতটি ছাড়িয়ে এক ঝটকায় মাটিতে পড়ে যায়। তার মুখ থেকে কষ্টের একটা আর্তনাদ বেরিয়ে আসে। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। এটা কি সত্যি তার মা! এদিকে কুঁজো বুড়ির এক হাত ছুটে গেলে প্রচন্ড শক্তিতে খাটের উপর মোচড় দিতে শুরু করে সে। অবস্থা বেগতিক দেখে কারোই তার অন্য হাতটি ধরার সাহস হয় না। বুড়ি কালামের হাত থেকে ছিড়ে আনা মাংসের টুকরো গোগ্রাসে গিলে ফেলে। তার মুখ দিয়ে অঝোরে লালা ঝরতে থাকে। সেটি দেখে কালামের বউ সেখানেই গরগর করে সব বমি করে দেয়। প্রচন্ড রকমের হাত-পা ছোড়াছুড়িতে এক সময় বুড়ির অন্য হাতের দড়িটিও খুলে যায়। খাট থেকে ধপাস করে মাটিতে পড়ে যায় বুড়ি। নিজেকে টেনে হেচড়ে কালামের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। ঘরের এক কোনায় আটকে পড়া কালাম প্রচন্ড ভয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। কেন জানি বুড়িকে দেখে তার প্রচন্ড রকমের ক্ষুদার্থ মনে হচ্ছিল। যেন এখুনি তার উপর হামলে পড়বে, টেনে ছিড়ে ভুরে তার হাতের বাকি মাংস খাবে। এর মধ্যে কোথা থেকে মিলিটারি একটি বাশ জোগাড় করে আনে। তারপর সেটি দিয়ে কুঁজো বুড়িকে ঠেলে গুতোয় কালামের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রচন্ড রকমের হিংস্র কুঁজো বুড়ি যেন আর মানুষের মধ্যে নেই। আস্ত একটি জন্তুতে পরিণত হয়েছে। মিলিটারির গুঁতোগুঁতিতে কোন কাজই হয় না। বরং আরও রেগে ফুঁসতে ফুঁসতে কালাম এর উপর লাফিয়ে পড়ার উপক্রম হয়। অগত্যা মিলিটারি কুজুবুড়ির মাথায় সজোরে একটি বাড়ি দিয়ে বসে। কুজোবুড়ি একটি আর্তচিৎকার করে উঠে। প্রায় সাথে সাথেই কালাম চিৎকার করে ওঠে, ভাইজান এইটা কি করলা? বাড়ি খেয়ে কুঁজো বুড়ি যেন হঠাৎ করেই খেই হারিয়ে ফেলে। উদ্দেশ্যহীনভাবে তার হাত দুটি ছুড়তে ছুড়তে শরীরের বাকি অংশ নিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই তার হাত-পা এর ছোড়াছুড়ি বন্ধ হয়ে যায়। এক পর্যায়ে কাঁপতে কাঁপতে তার অর্ধ দেহটি নিসার হয়ে পড়ে। অবস্থা দেখে কালাম লাফ দিয়ে ঘরের কোণা থেকে বেরিয়ে আসে। মিলিটারিকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে, এইটা কী করলা ভাইজান? আমরার মায়েরে মাইরা ফেললা! মিলিটারি কোন জবাব দিতে পারে না। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। এসবের মধ্যে কখন যে তার বুড়ো বাবা মূর্ছা খেয়ে গেছে বিষয়টি খেয়ালই করেনি কেউ। কালাম দৌড়ে তার বুড়ো বাপকে উঠানোর চেষ্টা করে। বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, শিগগির এক গ্লাস পানি নিয়ে আসো। কালামের বউ কোনভাবে উঠে কলসি থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে আসে। কালাম বুড়োর চোখে মুখে ছিটিয়ে দেয়। একটু পানি খাওয়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়না। বুড়োর মুখখানা নিথরভাবে কালামের হাতের উপর পড়ে থাকে। কালামের বউ বুড়োর বুকের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, বাজান তো কোন রকম শ্বাস নেয় না! কালাম তখনো কথাটি বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে বাপের কাধ ধরে ঝাকাতে শুরু করে। তাকে জাগানোর চেষ্টা করে। অবস্থা দেখে মিলিটারি দৌড়ে বাপের কাছে চলে আসে। হাত দিয়ে গলায় পালস পরীক্ষা করে। তারপর হতাশার ভঙ্গিতে বলে, বাজান নাই! সবাইকে একসাথে পেয়ে আবার একই দিনে তাদের হারানোর বেদনা কালাম যেন সইতে পারছিল না। তার বুক ভেঙে কান্না চলে আসে। দেয়াল চাপড়ে আহাজারি করতে থাকে।   কালামের বউ মিলিটারির দিকে ফিরে তাকায়, চিৎকার করে বলে ওঠে, আপনের জন্য হইছে সবকিছু! সব আপনের দোষ! মিলিটারি কোন কথা বলতে পারেনা। চোখ দিয়ে তার অঝরে পানি ঝরতে থাকে। আর মায়াকান্না দেখাইয়েন না! কালামের বউ বলতে থাকে। আপনেরে না ডাকলে এগুলা কিছুই হইতো না। আপনে মায়েরে মাইরা ফেলছেন! আপনে একটা খুনি! বদ্ধ পাগল! বাজানের মৃত্যুর জন্যেও আপনে দায়ী। আপনে ঘর থেকে বাইর হয়ে যান। মিলিটারি কোন কথা বলতে পারে না। ডুকরে কাঁদতে থাকে। নিঃশব্দে ঘরের কোণে তার ঝোলাটা হাতে নিয়ে ঘরের বাইরে পা বাড়ায়। যাওয়ার সময় সে কালামকে কিছু একটা বলতে চায়, তার নাম ধরে ডাকে। কালাম উত্তর দেয়, ওই মুখে আমার নাম নিও না। তুমি একটা অপয়া। তুমি এই বাড়ি থাকলে বাকি সবকিছুও ধ্বংস হইয়া যাইবে। চইলা যাও এখান থাইকা। আমিই তাগোর দাফন করমু! তোমারে আর কোনদিন দেখবার চাই না! নিজের মায়ের পেটের ভাইয়ের মুখে এরকম কথা শুনে আর পেছনে ফিরে তাকানোর সাহস হয় না মিলিটারির। মুখ বুজে দু-চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। (চলবে)
0 notes
luckytigerbird · 2 years
Text
পাঁচ ব্যাংকে অফিসার পদের লিখিত পরীক্ষার সূচি প্রকাশ
পাঁচ ব্যাংকে অফিসার পদের লিখিত পরীক্ষার সূচি প্রকাশ
ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির সদস্যভুক্ত পাঁচ ব্যাংকের (সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক) অফিসার (ক্যাশ) পদে এমসিকিউ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষার সময়সূচি প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়োগসংক্রান্ত ওয়েবসাইটে এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এসব প্রার্থীর লিখিত পরীক্ষা ২৮ মে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত নেওয়া…
Tumblr media
View On WordPress
0 notes
luckytigerbird · 2 years
Text
ডাক অধিদপ্তরের মৌখিক পরীক্ষার তারিখ প্রকাশ
ডাক অধিদপ্তরের মৌখিক পরীক্ষার তারিখ প্রকাশ
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অধীন ডাক অধিদপ্তরের দশম গ্রেডের সিনিয়র মেকানিক পদের মৌখিক পরীক্ষার সময়সূচি প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (বিপিএসসি) এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সিনিয়র মেকানিক পদে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা আগামী ৮ জুন অনুষ্ঠিত হবে।   রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ সরকারি…
Tumblr media
View On WordPress
0 notes
luckytigerbird · 2 years
Text
ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটিতে চাকরি, বেতন লাখের বেশি
ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটিতে চাকরি, বেতন লাখের বেশি
মার্কিন দাতা সংস্থা দ্য ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি (আইআরসি) তাদের বাংলাদেশ অফিসে জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি ফাইন্যান্স বিভাগে কর্মী নিয়োগ দেবে। আগ্রহী যোগ্য প্রার্থীরা অনলাইনে আবেদন করতে পারবেন। পদের নাম: ফাইন্যান্স ম্যানেজার–সাপোর্ট বিভাগ: ফাইন্যান্স পদসংখ্যা: অনির্ধারিত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা: অ্যাকাউন্টিং/ফাইন্যান্সে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকতে হবে। মানবাধিকার/উন্নয়ন সংস্থায়…
Tumblr media
View On WordPress
0 notes
luckytigerbird · 2 years
Text
প্রাথমিকে আরও ৫ হাজার শিক্ষক নিয়োগ
প্রাথমিকে আরও ৫ হাজার শিক্ষক নিয়োগ
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আরও ৫ হাজার ১৬৬ সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে। এর মধ্যে সংগীত বিষয়ে ২ হাজার ৫৮৩ জন ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে ২ হাজার ৫৮৩ জন। এই দুই বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাঠানো প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে সম্মতি জানিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে ৮ মে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। আটটি শর্তে…
Tumblr media
View On WordPress
0 notes
luckytigerbird · 2 years
Text
বেসরকারি সংস��থায় চাকরি, বেতন ৭০,০০০
বেসরকারি সংস্থায় চাকরি, বেতন ৭০,০০০
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওয়েভ ফাউন্ডেশন জনবল নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি প্রজেক্ট কো–অর্ডিনেটর পদে কর্মী নিয়োগ দেবে। আগ্রহী প্রার্থীরা অনলাইনে আবেদন করতে পারবেন। এ ছাড়া ডাকযোগে বা সরাসরিও আবেদন পাঠানো যাবে। পদের নাম: প্রজেক্ট কো–অর্ডিনেটর পদসংখ্যা: ১ যোগ্যতা: স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান বা এ ধরনের বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকতে হবে। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে অন্তত ছয় বছর চাকরির…
Tumblr media
View On WordPress
0 notes
luckytigerbird · 2 years
Text
চা-বাগানে চাকরি, আসবাব সহ বাংলো সুবিধা
চা-বাগানে চাকরি, আসবাব সহ বাংলো সুবিধা
সিলেটের মৌলভীবাজারে একটি বড় চা-বাগানে কর্মী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এই চা-বাগানে ‘হেড অব ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্ল্যায়েন্স—টি এস্টেট’ পদে কর্মী নিয়োগ দেওয়া হবে। আগ্রহী প্রার্থীদের অনলাইনে আবেদন করতে হবে। পদের নাম: হেড অব ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্ল্যায়েন্স—টি এস্টেট পদসংখ্যা: অনির্ধারিত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা: বিজনেস স্টাডিজে স্নাতক ডিগ্রিসহ যেকোনো বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি।…
Tumblr media
View On WordPress
0 notes
luckytigerbird · 2 years
Text
আইইউসিএনে চাকরি, বেতন লাখের বেশি
আইইউসিএনে চাকরি, বেতন লাখের বেশি
প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর জোট আইইউসিএন বাংলাদেশে কর্মী নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি বাংলাদেশ প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেশন ইউনিটে কর্মী নিয়োগ দেবে। আগ্রহী প্রার্থীদের অনলাইনে আইইউসিএনের ওয়েবসাইটে লগইন করে আবেদন করতে হবে।   পদের নাম: প্রোগ্রাম অফিসার—ইউএনএইচসিআর পদসংখ্যা: অনির্ধারিত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা: জুওলজি, ওয়াইল্ডলাইফ, ফরেস্ট্রি, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বা এ ধরনের যেকোনো বিষয়ে…
Tumblr media
View On WordPress
0 notes