abhijit70-blog
abhijit70-blog
Untitled
1 post
Don't wanna be here? Send us removal request.
abhijit70-blog · 6 years ago
Text
লিঙ্গ পরিচিতি
লিঙ্গ-পরিচয়, মানে শারীরিক লিঙ্গ পরিচিতির মধ্য দিয়ে আমাদের যে সামাজিক চলা শুরু হয়, সেই রেললাইন ধরে আমাদের চলতে হয় আমৃত্যু। ওই লাইন যেদিকে নিয়ে যাবে, সেদিকে যেতে বাধ্য হই আমরা। জীবনের প্রতি পরতে এই চিহ্ন আমাদের দাখিল করতে হয়। মানুষকে আলাদা আলাদা করা হয় শারীরিক লিঙ্গ দিয়ে। এমন সব জায়গায় আমাদের বলতে হয়, আমি কোন লিঙ্গের মানুষ, যেখানে লিঙ্গ কোন কাজেই লাগে না। সে স্কুল-কলেজে হোক, চাকরিতে হোক বা ট্রেনে-প্লেনে ভ্রমণেই হোক। যুক্তি আসতে পারে, লিঙ্গ না বললে, সংরক্ষণ হবে কিভাবে? কিভাবে নারীদের জন্য সংরক্ষিত সিট নারীকে দেওয়া যাবে? নারীদের জন্য সংরক্ষিত শৌচালয় কিভাবে নারীর জন্য সংরক্ষিত হবে? উত্তরে বলা যায়, সংরক্ষণের প্রয়োজনটাই তো হয়েছে নারী-পুরুষের এই বিস্তর সামাজিক ফারাকের ফলে। বর্তমানে অন্যান্য লিঙ্গদের জন্যও সংরক্ষণের প্রয়োজন মানুষ অল্প হলেও অনুভব করছে, সেও তাদের ক্ষেত্রে এই সামাজিক পার্থক্যটা আরও ব্যাপক, আরও গভীর বলে। সংরক্ষণ হল, একটা রোগ হয়ে যাওয়ার পর তার চিকিৎসা। কিন্তু যদি ভাবি, রোগটাই যদি না হত?
 এটা বলছি না যে, পুরুষ, নারী ও অন্যান্য লিঙ্গের মানুষের মধ্যে শারীরিক লিঙ্গের পার্থক্য হবার জন্য, অন্য কোন কাজের ক্ষমতার তফাৎ হয় না। সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা, সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো – এসবের ক্ষেত্রে নারীর একছত্রাধিকার তো আছেই। এছাড়াও আছে যৌনতা অনুভবের পার্থক্য, কে কিভাবে যৌন আনন্দ পাবে – তার তফাৎ। এটুকুই শারীরিক পার্থক্য। এছাড়া যদি শারীরিক ক্ষমতার পার্থক্য বলেন, তাহলে বলব, পুরুষকেও যদি বংশ-পরম্পরায় ন’-দশ বছর বয়স থেকেই অন্তর্মূখী করে ফেলা হয়, বাইরের কাজকর্ম, খেলাধূলা, ব্যায়াম ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করতে না দেওয়া হয়, তাকে যদি ঠিকভাবে বোঝানো যায় যে, মাংশপেশী বাড়ানোর কোন প্রয়োজনই নেই জীবনে, তাহলে পুরুষেরও ক্ষমতার ঘাটতি ঘটবে। সেরকম কোন একমোদ্বীতিয়ম “পুরুষ” সত্ত্বা, বা একই রকম আদলে তৈরী সার্বজনীন “নারী” সত্ত্বা বলে কিছু হয় না।
 মানুষের বিবর্তন সম্বন্ধে পুরুষতান্ত্রিক ইতিহাস আর নারীবাদী ইতিহাস ভিন্ন কথা বলে। সে প্রসঙ্গে, বা বলা ভাল সে বিতর্কে যাব না এখন। বরং এখানে আটকে থাকব পার্থক্য এবং অভিন্নতার প্রসঙ্গে।
 পার্থক্য তো কোন খারাপ জিনিস নয়। প্রকৃতিতে পার্থক্যই স্বাভাবিক। পার্থক্যকে ধারণ করেই সুস্থ সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠে। শুধু, সেই পার্থক্যের ফলে যখন কোন একদল নীচু শ্রেণির বলে গণ্য হয়, নিপীড়িত হয়, শোষিত হয়, সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জায়গা থেকে নানাভাবে বঞ্চিত হয়, তখন সেই পার্থক্য নিয়ে কথা বলতে হয়।
 তখন আমরা কি বলতে চাই? এই যেমন, একটা নির্দিষ্ট ধরনের সংস্কৃতিকে “হিন্দু” সংস্কৃতি বলে যখন চাপিয়ে দেওয়া হয়, আমরা বলি হিন্দু বলে কোন একটা সংস্কৃতি হয় না। তার মধ্যে শাকাহারী-নিরামিশাষী-আমিশাষী আছে, তার মধ্যে অত্যন্ত নরম-কিছুটা শক্ত-নির্মম মানুষ আছে, তার মধ্যে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্নভাবে তাদের দেবতা বা ভগবানের পূজা করে, তার মধ্যে নানান ভাষা আছে, নানান জাতি আছে, নানান বর্ণ আছে, নানান সংস্কৃতি ইত্যাদি। যখন সাদা চামড়ার বর্ণবিদ্বেষীরা সমাজে তাদের উচ্চাসন বজায় রাখতে এই পার্থক্য করে, তখন আমরা বলি আসলে সাদা-কাল এই দুভাগে মানুষকে ভাগ করা যায় না। নানান রঙের মানুষ আছে, এবং যেকোন রঙের মানুষের মধ্যেই আবার বহু পার্থক্যও আছে।
একই রকম ভাবে, শারীরিক পুং-লিঙ্গ থাকলেই তার শারীরিক ক্ষমতা খুব বেশি হবে, সে কম আবেগী এবং বেশি যুক্তিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হবে, ঘরের কাজ - শিশুপালন ইত্যাদি “নরম” কাজে অক্ষম হবে, প্রতিদ্বন্দীতাপরায়ণ এবং যুদ্ধকামী হবে, যৌনতায় উগ্র হবে, হিংস্র হবে, যৌনতার সঙ্গী হিসেবে নারীকেই চাইবে, এমন নয়। সমাজ অবশ্যই নানান পদ্ধতিতে, বিভিন্ন শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে তাকে এই ছাঁচে গড়ে তুলতে চায়, যাতে সব পুরুষই একই রকম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হয়ে ওঠে। তেমনি, শারীরিক স্ত্রীলিঙ্গ থাকলেই, সে মনের দিক থেকে খুব নরম হবে, আবেগপরায়ণ হবে, বেশির ভাগ সময়ে অযৌক্তিক হবে, বড় কোন সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ হবে, শারীরিকভাবে দুর্বল হবে এবং শারীরিক সক্ষমতা লাগে এমন কাজে অপটু হবে, যৌনতায় পুরুষকে সঙ্গ দেবে কিন্তু যৌনক্ষিদে কম থাকবে, এমন কোন কথা নেই। যদিও সমাজ তাকে এভাবেই গড়ে তোলার চেষ্টা করে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। আর হিজড়ে, কোতি, বা উভলিঙ্গ হলে তো কথাই নেই, তাকে সমাজের বাইরে রাখার জন্য সমাজ তার শেষ শক্তিটুকু প্রয়োগ করে। শুধুমাত্র ওই শারীরিক লিঙ্গের ভিত্তিতেই তাকে “অস্বাভাবিক” বলে ঘোষণা করে। ফলে কোন সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হবার সুযোগ সে পায় না। পুংলিঙ্গ না থাকার জন্য তার পুরুষ সমাজে ঠাঁই নাই। শুধু, কোনভাবে যদি সে স্ত্রীলিঙ্গের বৈশিষ্ট্যগুলো অল্প হলেও আয়ত্ত করতে পারে, তাহলে ব্রাত্য হয়েও সমাজের এক কোণে কোনরকমে বেঁচে-বর্তে থাকার অধিকার সে পাবে।
 তাহলে কি দাঁড়াল? সমাজের ঘোষণায় সব নারী এক রকম, সব পুরুষ এক রকম, আর সব অন্য লিঙ্গেরা এক রকম। এবং এই “একই রকম”দের সে একই ঘেটোতে রাখতে চাইল। যাতে তারা চীরকাল একই রকম থাকে। কিন্তু যেহেতু, পুরুষের যৌনতায় নারীকে লাগবে এবং সন্তানের জন্ম দেওয়ার জন্যও নারী-পুরুষকে একসাথে হতে হবে,  তাই পুরোপুরি আলাদা রাখা হল না। তৈরী হল পরিবার (পরিবারের অর্থনৈতিক গুরূত্বগুলো ইচ্ছে করেই আলোচনার বাইরে রাখছি)। কিন্তু সেখানে ভূমিকাগুলো নির্দিষ্ট করে দেওয়া হল। পুরুষ বাইরের ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে পরিবার সামলাবে, নারী ঘরের ভেতরটা সচল ও সুন্দর রাখবে। যেহেতু পুং -লিঙ্গের হাতেই সমাজের ক্ষমতা, সেইজন্য, যেভাবেই নারী-পুরুষের শরীর কাছাকাছি আসুক না কেন, স্ত্রীলিঙ্গের মধ্যে পুং-লিঙ্গের সফল প্রবেশই, সে সম্পর্কের শেষ কথা, এবং সেই সম্পর্কের সার্থকতা।
 সমসত্ত্ব এই দুটি গোষ্ঠী এবং সমাজ থেকে নির্বাসিত বাকি সব লিঙ্গের “অস্বাভাবিক” মানুষকে নিয়ে সামাজিক অনুশাসণ একটা নির্দিষ্ট নিয়মে চলতে লাগল।
 কিন্তু, বাস্তব তো সমসত্ত্ব নয়। এই কঠিন, কঠোর অনুশাসনের মধ্যেই পুরুষ পুরুষকে ভালবেসে ফেলছে, নারী ভালবেসে ফেলছে নারী বা রূপান্তরকামী কোন মানুষকে, কোথাও পুরুষ দারুণ নরমভাবে শিশুকে পালন করছে, কোথাও নারী শারীরিকভাবে দারুণ সক্ষম হয়ে উঠছে, কখনো পুরুষ নারীকে পুং-লিঙ্গ না থাকা সত্ত্বেও সমান সম্মান দিচ্ছে, কোথাও যৌনতার ক্ষেত্রে পুং-লিঙ্গের স্ত্রী-যোনীর মধ্যে অনুপ্রবেশকে আর অতটা গুরূত্ব দিচ্ছে না। ফলে অনুশাসন ভেঙ্গে মাঝে মধ্যেই বেরিয়ে আসছে তারা স্বাভাবিকভাবেই। বেরিয়ে এসে তারা বুঝতে পারছে, ছোটবেলা থেকে তার শরীরে যে “লিঙ্গ”টা দেখে তাকে একটা অনড় অচল পরিচয়ে ভূষিত করা হয়েছিল, সেটা ততটা গুরূত্বপূর্ণ নয়। তখন সে বুঝতে পারছে যে, এই পরিচয়টা তার বৈশিষ্ট্যের বহু সম্ভাব্যতাকে, অল্প কিছুর মধ্যে আটকে রেখেছিল।
 সে বুঝতে পারে, এর মধ্যে আছে ক্ষমতার খেলা। এই অটল, অচল, অব্যয় শারীরিক লিঙ্গ পরিচয় কিভাবে নানাবিধ নিপীড়ন ও শোষণের সংস্কৃতি তৈরী করে, তা সে অনুভব করতে শুরু করে। তখন সে প্রতিবাদ করতে চায়, প্রশ্ন করতে চায়। যেমন প্রশ্ন ওঠে, জন্ম থেকেই একজনকে কেন দলিত আখ্যা দেওয়া হবে, কেন একজনের ধর্ম জন্ম থেকেই নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে? এবং সেই সংস্কৃতির সমুদ্রে ডূবে থাকা বহু মানুষ সেগুলোকে পাগলের প্রলাপ বলেই ভাবে। ঠিক তেমনি এ প্রশ্নও ওঠে, কেন একজনকে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একটা লিঙ্গের দ্বারাই, বা তার শরীরের ওই একটা অঙ্গ দিয়েই সারাজীবন চিহ্নিত হতে হবে? এবং একইরকম ভাবে আপনি সেই প্রশ্নকেও উন্মাদের অস্বাভাবিক আচরণ বলে ধরে নিতে পারেন!
1 note · View note